পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/২৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চরকা
২৫৭

হবে, নইলে সমাজ চলবে না। এই-সব মানুষকে মুখে dignity দিয়ে কেউ কখনােই dignity দিতে পারবে না। চাকা অসংখ্য শূদ্রকে শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই চাকাই চরকায় কুমােরর চাকে, গাড়ির তলায় স্থূল সূক্ষ্ম নানা আকারে মানুষের প্রভূত ভার লাঘব করেছে। এই ভার লাঘবের মতাে ঐশ্বর্যের উপাদান আর নেই, এ কথা মানুষ বহুযুগ পূর্বে প্রথম বুঝতে পারলে যেদিন প্রথম চাকা ঘুরল। ইতিহাসের সেই প্রথম অধ্যায়ে যখন চরকা ঘুরে মানুষের ধন-উৎপাদনের কাজে লাগল ধন তখন থেকে চক্রবর্তী হয়ে চলতে লাগল, সেদিনকার চরকাতেই এসে থেমে রইল না। এই তথ্যটির মধ্যে কি কোনাে তত্ত্ব নেই? বিষ্ণুর শক্তির যেমন একটা অংশ পদ্ম তেমনি আর-একটা অংশ চক্র। বিষ্ণুর সেই শক্তির নাগাল মানুষ যেই পেলে অমনি সে অচলতা থেকে মুক্ত ইল। এই অচলতাই হচ্ছে মূল দারিদ্র। সকল দৈবশক্তিই অসীম, এইজন্যে চলনশীল চক্রের এখনাে আমরা সীমায় এসে ঠেকি নি। এমন উপদেশ যদি মেনে বসি যে, সুতাে কাটার পক্ষে আদিম কালের চরকাই শেষ তা হলে বিষ্ণুর পূর্ণ প্রসন্নতা কখনােই পাব না, সুতরাং লক্ষ্মী বিমুখ হবেন। বিজ্ঞান মর্তলােকে এই বিষ্ণুচক্রের অধিকার বাড়াচ্ছে এ কথা যদি ভুলি, তা হলে পৃথিবীতে অন্য যে-সব মানুষ চক্রীর সম্মান রেখেছে তাদের চক্রান্তে আমাদের মরতে হবে।

 বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মহাচক্রের যে বিরাট শক্তিরূপ দেখা যায় সেটাকে যখন ভুলি, যখন কোনাে-এক বিশেষ কালের বিশেষ চরকাকেই সুতাে কাটবার চরম উপাদান রূপে দেখি ও অভ্যস্তভাবে ব্যবহার করি, তবে চরকা ভিতরের দিক থেকে আমাদের কাছে বােবা হয়ে থাকে; তখন যে চরকা মানুষকে একদিন শক্তির পথে, ধনের পথে, অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে সে আর এগােবার কথা বলে না। কানের কাছে আওয়াজ করে তা নয়, কিন্তু মনের সঙ্গে কথা কয় না।

১৭