পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭২
কালান্তর

করবার দৃষ্টান্ত বৎসর বৎসর স্বচক্ষে দেখা সত্ত্বেও এই অনভ্যস্ত পথে যেতে চায় না।

 যখন কোনাে-একটা সমস্যার কথা ভাবতে হয় তখন মানুষের মনকে কী করে এক পথ থেকে আর-এক পথে চালানাে যায়, সেই শক্ত কথাটা ভাবতে হয়; কোনাে-একটা সহজ উপায় বাহ্যিকভাবে বাৎলিয়ে দিলেই যে কাজ হাসিল হয় তা বিশ্বাস করি নে মানুষের মনের সঙ্গে রফা-নিষ্পত্তি করাই হল গােড়ার কাজ। হিন্দু-মুসলমানের মিলন হােক বাহিরের দিক থেকে এই পরােয়ানা জাহির করা কঠিন নয়। এই উপলক্ষে হিন্দুরা খিলাফত আন্দোলনে যােগ দিতে পারে, কেননা সেরকম যোগ দেওয়া খুবই সহজ। এমন-কি, নিজেদের আর্থিক সুবিধাও মুসলমানদের জন্য অনেক পরিমাণে ত্যাগ করতে পারে; সেটা দুরূহ সন্দেহ নেই, তবু এই বাহ্য। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মিলনের উদ্দেশে পরস্পরের মনের চিরাগত সংস্কারের পরিবর্তন করা সহজ নয়। সমস্যাটা সেইখানেই ঠেকেছে। হিন্দুর কাছে মুসলমান অশুচি, আর মুসলমানের কাছে হিন্দু কাফের- স্বরাজপ্রাপ্তির লােভও এ কথাটা ভিতর থেকে উভয় পক্ষের কেউ ভুলতে পারে না। আমি একজন ইংরেজিনবিশের কথা জানতেম, হােটেলের খানার প্রতি তার খুব লােভ ছিল। তিনি আর-সমস্তই রুচিপূর্বক আহার করতেন, কেবল গ্রেট-ইস্টার্নের ভাতটা বাদ দিতেন; বলতেন, মুসলমানের রান্না ভাতটা কিছুতেই মুখে উঠতে চায় না। যে সংস্কারগত কারণে ভাত খেতে বাধে সেই সংস্কারগত কারণেই মুসলমানের সঙ্গে ভালাে করে মিলতে তার বাধবে। ধর্ম-নিয়মের আদেশ নিয়ে মনের যে-সকল অভ্যাস আমাদের অন্তর্নিহিত সেই অভ্যাসের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান-বিরােধের দৃঢ়তা আপন সনাতন কেল্লা বেঁধে আছে; খিলাফতের আনুকূল্য বা আর্থিক ত্যাগস্বীকার সেই অন্দরে গিয়ে পৌঁছয় না।