পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৪
কালান্তর

কর্তৃত্বকে কাঁধে চাপাইলেই বোঝা হইয়া ওঠে। ওটাকে এমন একটা চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ির উপর নামাননা হোক যেটাকে আমরাও নিজের হাতে ঠেলিতে পারি।

 আজকের দিনে এই প্রার্থনা পৃথিবীর সব দেশেই জাগিয়া উঠিয়াছে যে, বাহিরের কর্তার সম্পূর্ণ একতরফা শাসন হইতে মানুষ ছুটি লইবে। এই প্রার্থনায় আমরা যে যোগ দিয়াছি তাহা কালের ধর্মে; না যদি দিতাম, যদি বলিতাম, রাষ্ট্রব্যাপারে আমরা চিরকালই কর্তাভজা— সেটা আমাদের পক্ষে নিতান্ত লজ্জার কথা হইত। অন্তত একটা ফাটল দিয়াও সত্য আমাদের কাছে দেখা দিতেছে, এটাও শুভলক্ষণ।

 সত্য দেখা দিল বলিয়াই আজ এতটা জোর করিয়া বলিতেছি যে, দেশের যে আত্মাভিমানে আমাদের শক্তিকে সম্মুখের দিকে ঠেলা দিতেছে। তাকে বলি ‘সাধু’, কিন্তু যে আত্মাভিমান পিছনের দিকের অচল খোঁটায় আমাদের বলির পাঁঠার মতো বাঁধিতে চায় তাকে বলি ‘ধিক্’। এই আত্মাভিমানে বাহিরের দিকে মুখ করিয়া বলিতেছি, রাষ্ট্রতন্ত্রের কর্তৃত্ব-সভায় আমাদের আসন পাতা চাই; আবার সেই অভিমানেই ঘরের দিকে মুখ ফিরাইয়া হাঁকিয়া বলিতেছি ‘খবরদার! ধর্মতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে, এমন-কি, ব্যক্তিগত ব্যবহারে কর্তার হুকুম ছাড়া এক পা চলিবে না’— ইহাকেই বলি হিন্দুয়ানির পুনরুজ্জীবন। দেশাভিমানের তরফ হইতে আমাদের উপর হুকুম আসিল, আমাদের এক চোখ জাগিবে, আর-এক চোখ ঘুমাইবে। এমন হুকুম তামিল করাই দায়।

 বিধাতার শাস্তিতে আমাদের পিঠের উপর যখন বেত পড়িল তখন দেশাভিমান ধড়্ফড় করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ওড়াও ঐ বেতবনটাকে।’ ভুলিয়া গেছে, বেতবনটা গেলেও বাঁশবনটা আছে। অপরাধ বেতেও নাই, বাঁশেও নাই, আছে আপনার মধ্যেই। অপরাধটা এই যে, সত্যের জায়গায় আমরা কর্তাকে মানি, চোখের চেয়ে চোখের ঠুলিকে শ্রদ্ধা করাই আমাদের