পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮
কালান্তর

সহিষ্ণুতার সৌন্দর্য আছে। কিন্তু আমাদের দেশের অন্তর্যামী এই অন্ধ নিষ্ঠার সৌন্দর্যকে গ্রহণ করেন নাই। তিনি পুরস্কার দিলেন না, শাস্তিই দিলেন। দুঃখ বাড়িতেই চলিল। এই মেয়েরা মানত-স্বস্ত্যয়নের বেড়ার মধ্যে যে-সব ছেলে মানুষ করিয়াছে, ইহকালের সমস্ত বস্তুর কাছেই তারা মাথা হেঁট করিল এবং পরকালের সমস্ত ছায়ার কাছেই তারা মাথা খুঁড়িতে লাগিল। নিজের কাজের বাধাকে রাস্তার বাঁকে বাঁকে গাড়িয়া দেওয়াই এদের কাজ, এবং নিজের উন্নতির অন্তরায়কে আকাশপরিমাণ উঁচু করিয়া তোলাকেই এরা বলে উন্নতি। সত্যের জন্য মানুষ কষ্ট সহিবে, এইটেই সুন্দর। কানা বুদ্ধি কিম্বা খোঁড়া শক্তির হাত হইতে মানুষ লেশমাত্র কষ্ট যদি সয়, তবে সেটা কুদৃশ্য। কারণ বিধাতা আমাদের সব চেয়ে বড়ো যে সম্পদ দিয়াছেন, ত্যাগ-স্বীকারের বীরত্ব, এই কষ্ট তারই বেহিসাবি বাজে খরচ। আজ তারই নিকাশ আমাদের চলিতেছে— ইহার ঋণের ফর্দটাই। মোটা। চোখের সামনে দেখিয়াছি, হাজার হাজার মেয়ে পুরুষ পুণ্যের সন্ধানে যে পথ দিয়া স্নানে চলিয়াছে ঠিক তারই ধারে মাটিতে পড়িয়া একটি বিদেশী রোগী মরিল, সে কোন্ জাতের মানুষ জানা ছিল না বলিয়া কেহ তাহাকে ছুঁইল না। এই তো ঋণদায়ে দেউলিয়ার লক্ষণ। এই কষ্টসহিষ্ণু পুণ্যকামীদের নিষ্ঠা দেখিতে সুন্দর, কিন্তু ইহার লোকসান সর্বনেশে। যে অন্ধতা মানুষকে পুণ্যের জন্য জলে স্নান করিতে ছোটায়, সেই অন্ধতাই তাকে অজানা মূমূর্মুর সেবায় নিরস্ত করে। একলব্য পরমনিষ্ঠুর দ্রোণাচার্যকে তার বুড়ো আঙুল কাটিয়া দিল, কিন্তু এই অন্ধ নিষ্ঠার দ্বারা সে নিজের চিরজীবনের তপস্যাফল হইতে তার সমস্ত আপন-জনকে বঞ্চিত করিয়াছে। এই-যে মূঢ় নিষ্ঠার নিরতিশয় নিষ্ফলতা বিধাতা ইহাকে সমাদর করেন না, কেননা ইহা তাঁর দানের অবমাননা। গয়াতীর্থে দেখা গেছে, যে পাণ্ডার না আছে বিদ্যা না আছে চারিত্র, ধনী স্ত্রীলোক রাশি রাশি টাকা ঢালিয়া দিয়া তার পা পূজা করিয়াছে। সেই