পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম
৭৯

রাখ, তবে তার চেয়ে পরম শত্রুতা আর-কিছু হইতেই পারে না। ডাইনে বাঁয়ে দু পা বাড়াইলেই যার মাথা ঠক করিয়া দেয়ালে গিয়া ঠেকে, তার মনে কখনো কি সেই বড়ো আশা টিকিতেই পারে যার জোরে মানুষ সকল বিভাগে আপন মহত্বকে প্রাণ দিয়াও সপ্রমাণ করে?

 দেখিয়াছি, ইতিহাসে যখন প্রভাত হয় সূর্য তখন পূর্ব দিকে ওঠে বটে, কিন্তু সেইসঙ্গেই উত্তরে দক্ষিণে পশ্চিমেও আলো ছড়াইয়া পড়ে। এক-এক ইঞ্চি করিয়া ধাপে ধাপে যদি জাতির উন্নতি হইত তবে মহাকালকেও হার মানিতে হইত। মানুষ আগে সম্পূর্ণ যোগ্য হইবে, তার পরে সুযোগ পাইবে, এই কথাটাই যদি সত্য হয় তবে পৃথিবীতে কোনো জাতিই আজ স্বাধীনতার যোগ্য হয় নাই। ডিমক্রেসির দেমাক করিতেছ। কিন্তু য়ুরোপের জনসাধারণের মধ্যে আজও প্রচুর বীভৎসতা আছে— সে-সব কুৎসার কথা ঘাঁটিতে ইচ্ছা করে না। যদি কোনো কর্ণধার বলিত এই সমস্ত যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ডিমক্রেসি তার কোনো অধিকার পাইবে না, তবে বীভৎসতা তো থাকিতই, আবার সেই পাপের স্বাভাবিক প্রতিকারের উপায়ও চলিয়া যাইত।

 তেমনি আমাদের সমাজে, আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ধারণায় দুর্বলতা যথেষ্ট আছে, সে কথা ডাকিতে চাহিলেও ঢাকা পড়িবে না। তবু আমরা আত্মকর্তৃত্ব চাই। অন্ধকারে ঘরে এক কোণের বাতিটা মিট্মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে বলিয়া যে আর-এক কোণের বাতি জ্বালাইবার দাবি নাই, এ কাজের কথা নয়। যে দিকের যে সলতে দিয়াই হোক আলো জ্বালাই চাই। আজ মনুষ্যত্বের দেয়ালি-মহোৎসবে কোনো দেশই তার সব বাতি পুরা জ্বালাইয়া উঠিতে পারে নাই, তবু উৎসব চলিতেছে। আমাদের ঘরের বাতিটা কিছুকাল হইতে নিবিয়া গেছে; তোমাদের শিখা হইতে যদি ওটাকে জ্বালাইয়া লইতে যাই তবে তা লইয়া রাগারাগি করা কল্যাণের নহে। কেননা, ইহাতে তোমাদের আলো কমিবে না, এবং উৎসবের আলো বাড়িয়া উঠিবে।