পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৭২
গল্পগুচ্ছ

আমাদের সঙ্গে অভদ্রতা করল, তাতে কি আমাদেরই অপমান হয় না!”

 যাই হোক, সেক্রেটারি ও প্রফেসার উভয় পক্ষের কথা শুনে বিবেচনা করে নীহারকে বললেন, “সব দিক থেকে প্রমাণ হল ক্লাসে তুমিই প্রথম উৎপাত শুরু কর এবং তুমিই ছিলে দলের অগ্রণী। এ ক্ষেত্রে তোমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত।”

 নীহার বললে, “সার, আমার দ্বারা এটা সম্ভব নয়, তার চেয়ে অনুমতি দিন— আমি কলেজ ছাড়তে রাজি।”

 সেক্রেটারি বললেন, “তোমাকে সময় দিচ্ছি, ভালো করে ভেবে দেখো।”

 সে তথাস্তু ব’লে খাতাপত্র নিয়ে উঠে পড়ল। সেদিন ক্লাসের শেষে ছেলেমেয়েরা বাইরে নেমে দেখলে, নোটিশ বোর্ডে নোটিশ টাঙানো রয়েছে— আজ থেকে পুজোর ছুটি আরম্ভ হল।


সলিলার সঙ্গে নীহারের ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। সে নীহারকে প্রস্তাব করলে, “তুমিও দার্জিলিঙে চলে এসো।”

 নীহার বললে, “আমার বাপ তো তোমার বাপের মতো লক্ষপতি নয়। দার্জিলিঙে পড়াশুনা করি এমন শক্তি কোথায়।”

 শুনে সে মেয়ে বললে, “আচ্ছা, আমি দেব তোমার খরচ।”

 নীহারের এই গুণ ছিল, তাকে যা দেওয়া যায় তা পকেটে করে নিতে একটুও ইতস্তত করে না। সে ধনী ছাত্রীর খরচায় দার্জিলিঙে যাওয়াই ঠিক করলে।

 এ দিকে যত অহংকারই সুরীতির থাক, নীহারের মনের টান যে সলিলার দিকে সেটা তার মনে বাজল। নীহার ধনী মেয়ের আশ্রয়ে সুরীতির প্রতি আরও বেশি যখন-তখন যা-তা বলতে লাগল। সে বলত, ‘পুরুষের কাছে ভদ্রতার দাবি করতে পারে সেই মেয়েরাই, যারা মেয়েদের স্বভাব ছাড়ে নি।’ পুরুষের কাছ থেকে এই অনাদর সুরীতি ঘাড় বেঁকিয়ে অগ্রাহ্য করবার ভান করত। কিন্তু তার মনের ভিতরে এই নীহারের মন পাবার ইচ্ছাটা যে ছিল না, তা বলা যায় না। নীহার ধনী মেয়ের কাছ থেকে মাসোহারা নিত, তাতে ছেলেরা কেউ কেউ ঈর্ষা ক’রে ও কেউ কেউ ঘৃণা ক’রে নীহারকে বলত ‘ঘরজামাই’। নীহার তা গ্রাহ্যই করত না। তার দরকার ছিল পয়সার। যতক্ষণ পর্যন্ত তার ফিরপোর দোকানে বন্ধুদের নিয়ে পিক্‌নিক্ করবার খরচ চলত এবং নানা প্রকার সৌখিন ও দরকারী জিনিসের সরবরাহ সুসাধ্য হয়ে উঠত, ততদিন পর্যন্ত সেই মেয়ের আশ্রিত হয়ে থাকতে তার কিছুমাত্র সংকোচ হত না। দরকার হলেই নীহার সলিলার কাছে টাকা চেয়ে পাঠাত। এই-যে তার একজন পুরুষ পোষ্য ছিল, তার প্রতিভার উপর সলিলার খুব বিশ্বাস ছিল। মনে করেছিল এক সময়ে নীহার একটা মস্ত নাম করবে। সমস্ত বিশ্বের কাছে তার প্রতিভার যে একটা অকুণ্ঠিত দাবি আছে— নীহার সেটার আভাস দিতে ছাড়ত না, সলিলাও তা মেনে নিত।

 সলিলা দার্জিলিঙে থাকতে থাকতেই এক সময়ে তার ডবল নিমোনিয়া হল, চিকিৎসার ত্রুটি হল না, কিন্তু যমদূতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না। মৃত্যু হল সলিলার। শেষ পর্যন্ত নীহার তাকিয়েছিল হয়তো উইলে তার নামে কিছু দিয়ে