পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছোটো গল্প
৮৯৭

আমাদের ওখানে খেতে যেতে হবে তো।”

 “কিছু বলতে হবে না দাদু, যাবার জন্যে ওঁর মন লাফালাফি করছে। আমি যে এইমাত্র ওঁকে বলে দিয়েছি দেশকালের মিলনতত্ত্ব তুমি ব্যাখ্যা করবে।”

 মনে মনে বললুম, ‘বাস্ রে, কী দুষ্টমি।’

 অধ্যাপক উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলেন, “আপনার বুঝি টাইম-ম্পেস’এর—”

 আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলুম, “কিছু, জানা নেই— বোঝাতে গেলে আপনার বৃথা সময় নষ্ট হবে।”

 বৃদ্ধ ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন, “এখানে সময়ের অভাব কোথায়। আচ্ছা, এক কাজ করন-না, আজই চলুন আমার ওখানে আহার করবেন।”

 আমি লাফ দিয়ে বলতে যাচ্ছিলুম, ‘এখ্‌খনি।’ অচিরা বলে উঠল, “দাদু, সাথে তোমাকে বলি ছেলেমানুষ? যখন খুশি নেমন্তন্ন করে ফেল, আমি পড়ি মুশকিলে। ওঁরা বিলেতের ডিনার-খাইরে সর্বগ্রাসী মানুষ, কেন তোমার নাতনির বদনাম করবে!”

 অধ্যাপক ধমক-খাওয়া বালকের মতো বললেন, “আচ্ছা, তবে আর কোন্ দিন আপনার সুবিধে হবে বলুন।”

 “সুবিধে আমার কালই হতে পারবে কিন্তু অচিরাদেবীকে রসদ নিয়ে বিপন্ন করতে চাই নে। পাহাড়ে পর্বতে ঘুরি, সঙ্গে রাখি থলি ভরে চিঁড়ে, ছড়া কয়েক কলা, বিলিতি-বেগুন, কাঁচা ছোলার শাক, চিনেবাদাম। আমিই বরঞ্চ সঙ্গে নিয়ে আসব ফলারের আয়োজন। অচিরাদেবী যদি স্বহস্তে দই দিয়ে মেখে দেন লজ্জা পাবে ফিরপোর দোকান।”

 “দাদু, বিশ্বাস কোরো না এই-সব মুখমিষ্টি লোককে। উনি নিশ্চয় পড়েছেন তোমার সেই লেখাটা বাংলা কাগজে, সেই ভিটামিনের গুণপ্রচার। তাই তোমাকে খুশি করবার জন্যে শোনালেন চিঁড়েকলার ফর্দ।”

 মুশকিলে ফেললে। বাংলা কাগজ পড়া তো আমার ঘ’টেই ওঠে না।

 অধ্যাপক উৎফুল্ল হয়ে জিগ্‌গেসা করলেন, “সেটা পড়েছেন বুঝি?”

 অচিরার চোখের কোণে দেখতে পেলাম একটা হাসি। তাড়াতাড়ি শব্দ করে দিলাম, “পড়ি আর নাই পড়ি তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে—”

 আসল কথাটা আর হাতড়ে পাই নে।

 অচিরা দয়া করে ধরিয়ে দিলে, “আসল কথা উনি নিশ্চিত জানেন, কাল যদি তোমার ওখানে নেমন্তন্ন জোটে তা হলে ওঁর পাতে পশুপক্ষী স্থাবরজঙ্গম কিছুই বাদ যাবে না। তাই অত নিশ্চিন্ত মনে বিলিতি-বেগুনের নামকীর্তন করলেন। দাদু, তুমি সবাইকে অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস কর, এমন-কি, আমাকেও। সেইজন্যেই ঠাট্টা করে তোমাকে কিছু বলতে সাহস হয় না।”

 কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে ওঁদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছি এমন সময় অচিরা হঠাৎ আমাকে বলে উঠল, “বাস্, আর নয়— এইবার যান বাসার ফিরে।”

 আমি বললুম, “দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেব।”

 অচিরা বললে, “সর্বনাশ! দরজা পেরলেই আলুথালু, উচ্ছৃঙ্খলতা, আমাদের