পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯০০
গল্পগুচ্ছ

পাছে আমি দুঃখ করি দাদুর জেগে উঠল সায়েন্সের বিদ্যে। নিমকিতে নতুনের বদলে যদি চিনি দিত তা হলে নিশ্চয় দাদু বলত, চিনিতে শরীরের এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।—

 “দাদু, ও দাদু, তুমি ওখানে বসে বসে কী পড়ছ। আমি যে এ দিকে তোমার চরিত্রে অতিশয়োক্তি-অলংকার আরোপ করছি, আর নবীনবাবু সমস্তই বেদবাক্য বলে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন।”

 কিছু দূরে পোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির উপরে বসে অধ্যাপক বিলিতি ত্রৈমাসিক পড়ছিলেন। অচিরার ডাক শুনে সেখান থেকে উঠে আমাদের কাছে বসলেন। ছেলেমানুষের মতো হঠাৎ আমাকে জিগ্‌গেসা করলেন, “আচ্ছা নবীন, তোমার কি বিবাহ হয়েছে।”

 কথাটা এতই সুস্পষ্টভাবব্যঞ্জক যে আর কেউ হলে বলত না, কিংবা ঘুরিয়ে বলত।

 আমি আশাপ্রদ ভাষায় উত্তর দিলাম, “না, এখনও হয় নি।”

 অচিরার কাছে কোনো কথা এড়ায় না। সে বললে, “ঐ এখনও শব্দটা সংশয়গ্রস্ত কন্যাকর্তাদের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, ওর কোনো যথার্থ অর্থ নেই।”

 “একেবারেই নেই নিশ্চিত ঠাওরালেন কী করে।”

 “ওটা গণিতের প্রব্লেম, সেও হাইয়ার ম্যাথ্‌ম্যাটিক্‌স্ নয়। পূর্বেই শোনা গেছে আপনি ছত্রিশ বছরের ছেলেমানুষ। হিসেব করে দেখলাম এর মধ্যে আপনার মা অন্তত পাঁচ-সাত-বার বলেছেন, ‘বাবা, ঘরে বউ আনতে চাই।’ আপনি জবাব করেছেন, ‘তার পূর্বে ব্যাঙ্কে টাকা আনতে চাই।’ মা চোখের জল মুছে চুপ করে রইলেন, তার পরে মাঝখানে আপনার আর-সব ঘটেছিল— কেবল ফাঁসি ছিল বাকি। শেষকালে এখানকার রাজসরকারে মোটা মাইনের কাজ জুটল। মা বললেন, ‘এইবার বউ নিয়ে এসো ঘরে। বড়ো কাজ পেয়েছ।’ আপনি বললেন, ‘বিয়ে করে সে কাজ মাটি করতে পারব না।’ আপনার ছত্রিশ বছরের গণিতফল গণনা করতে ভুল হয়েছে কি না বলুন।”

 এ মেয়ের সঙ্গে অনবধানে কথা বলা নিরাপদ নয়। কিছুদিন আগেই আমার একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। কথায় কথায় অচিরা আমাকে বলেছিল, “আমাদের দেশের মেয়েরা আপনাদের সংসারের সঙ্গিনী হতে পারে কিন্তু বিলেতে যারা জ্ঞানের তাপস তাদের তপস্যার সঙ্গিনী তো জোটে যেমন ছিলেন অধ্যাপক কুরির সধর্মিণী মাদাম কুরি। আপনার কি তেমন কেউ জোটে নি।”

 মনে পড়ে গেল ক্যাথারিনকে। সে একই কালে আমার বিজ্ঞানের এবং জীবনযাত্রার সাহচর্য করতে চেয়েছিল।

 অচিরা জিগ্‌গেসা করলে, “আপনি কেন তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন না।”

 কী উত্তর দেব ভাবছিলাম—অচিরা বললে, “আমি জানি কেন। আপনার সত্যভঙ্গ হবে এই ভয় ছিল; নিজেকে আপনার মুক্ত রাখতেই হবে। আপনি যে সাধক। আপনি তাই নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর নিজের প্রতি, নিষ্ঠুর তার ’পরে যে আপনার পথের সামনে আসে। এই নিষ্ঠুরতায় আপনার বীরত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত।”

 কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার সে বললে, “বাংলা সাহিত্য বোধ হয় আপনি