পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছোটো গল্প
১০৫

কথা, মোহরস দিরে জারানো। আপনাদের মতো বুকের-পাটা-ওয়ালা লোকের মুখে মানায় না। প্রথম যখন আপনাকে দেখেছিলুম, তখন দেখেছি আপনি রস খুঁজে বেড়ান নি, পথ খুঁড়ে বেরিয়েছিলেন কড়া মাটি ভেঙে। দেখেছি আপনার নিরাসক্ত পৌরুষের মূর্তি— সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আপনাকে প্রণাম করেছি। আজ আপনি কথার পুতুল দিয়ে নিজেকে ভোলাতে বসেছেন। এ দশা ঘটালে কে। স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করি, এর কারণ কি আমি।”

 আমি বললুম, “তা হতে পারে। কিন্তু আপনি তো সাধারণ মেয়ে নন। পুরুষকে আপনি শক্তি দেবেন।”

 “হাঁ, শক্তি দেব, যদি নিজেকেই মোহ জড়িয়ে না ধরে। আভাসে বুঝেছি আপনি আমার ইতিহাস কিছু কিছু সংগ্রহ করেছেন। আপনার কাছে কিছু ঢাকবার দরকার নেই। আপনি শুনেছেন আমি ভবতোষকে ভালোবেসেছিলুম।”

 “হাঁ, শুনেছি।”

 “এও জানেন আমার ভালোবাসার অপমান ঘটেছে।”

 “হাঁ, জানি।”

 “সেই অপমানিত ভালোবাসা অনেক দিন ধরে আমাকে আঁকড়ে ধরে দুর্বল করেছে। আমি জেদ করে বসেছিলুম তারই একনিষ্ঠ স্মৃতিকে জীবনের পূজামন্দিরে বসাব। চিরদিন একমনে সেই নিষ্ফল সাধনা করব মেয়েরা যাকে বলে সতীত্ব। নিজের ভালোবাসার অহংকারে সংসারকে ঠেলে ফেলে নির্জনে চলে এসেছি। কর্তব্যকে অবজ্ঞা করেছি, নিজের দুঃখকে সম্মান করব বলে। আমার দাদুকে অনায়াসে সরিয়ে এনেছি তাঁর কাজের ক্ষেত্র থেকে। যেন এই মেয়েটার হৃদয়ের অহমিকা পৃথিবীর সব কিছুর উপরে। মোহ, মোহ, অন্ধ মোহ!”

 খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ সে বলে উঠল, “জানেন? আপনিই সেই মোহ ভাঙিয়ে দিয়েছেন।”

 বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলুম।

 সে বললে, “আপনিই এই আত্মাবমাননা থেকে ছিনিয়ে এনে আমাকে বাঁচালেন।”

 স্তব্ধ রইলুম নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে।

 “আপনি তখনও আমাকে দেখেন নি। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখেছি আপনার সুসাধ্য প্রয়াসের দিনগুলি—সঙ্গ নেই, আরাম নেই, ক্লান্তি নেই, একটু কোথাও ছিদ্র নেই অধ্যবসায়ে। দেখেছি আপনার প্রশস্ত ললাট, আপনার চাপা ঠোঁটে অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তির লক্ষণ, আর দেখেছি মানুষকে কী রকম অনায়াসে প্রভুত্বের জোরে চালনা করেন। দাদুর কাছে আমি মানুষ—আমি পুরুষের ভক্ত, যে পুরুষ সত্য, যে পুরুষ তপস্বী। সেই পুরুষকেই দেখবার জন্যে আমার ভক্তিপিপাসু নারী ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করে ছিল নিজের অগোচরে। মাঝখানে এসেছিল অপদেবতা প্রবৃত্তির টানে। অবশেষে নিষ্কাম পুরুষের সুদৃঢ় শক্তিরূপ আপনিই আনলেন আমার চোখের সামনে।”

 আমি জিগ্‌গেসা করলুম, “তার পর কি ভাবের পরিবর্তন হয়েছে।”

 “হাঁ, হয়েছে। আপনার বেদি থেকে নেমে এসেছেন প্রতিদিন। স্থানীয় কাগজে পড়লুম, দূরে অন্য এক জায়গায় সন্ধানের কাজে আপনার ডাক পড়েছে। আপনি