পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 একজন বাহির হইতে রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “ঘরে কে আছে।”

 গৃহ হইতে কমলের মাতা উত্তর দিলেন। সে শাখাদীপ হস্তে গৃহে প্রবেশ করিল এবং কমলের মাতাকে কী কহিল, শুনিবামাত্র বিধবা চীৎকার করিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 এ দিকে তুষারক্লিষ্ট কমল ক্রমে ক্রমে চেতন লাভ করিল, চক্ষু মেলিয়া চাহিল। দেখিল— একটি প্রকাণ্ড গুহা, ইতস্ততঃ বৃহৎ শিলাখণ্ড বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে, গাঢ় ধূম্র মেঘে গুহা পূর্ণ, সেই মেঘের অন্ধকার ভেদ করিয়া শাখাদীপের আলোকদীপ্ত কতকগুলি কঠোর শ্মশ্রুপূর্ণ মুখ কমলের মুখের দিকে চাহিয়া আছে। প্রাচীরে কুঠার কৃপাণ প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্র লম্বিত আছে, কতকগুলি সামান্য গার্হস্থ্য উপকরণ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। বালিকা সভয়ে চক্ষু নিমীলিত করিল।

 আবার চক্ষু মেলিয়া চাহিল। একজন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি।”

 বালিকা উত্তর দিতে পারিল না, বালিকার বাহু ধরিয়া সবেগে নাড়াইয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুই।”

 কমল ভীতিকম্পিত মৃদুস্বরে কহিল, “আমি কমল।”

 সে মনে করিয়াছিল এই উত্তরেই তাহারা তাহার সমস্ত পরিচয় পাইবে।

 একজন জিজ্ঞাসা করিল, “আজ সন্ধ্যার দুর্যোগের সময় পথে ভ্রমণ করিতেছিলে কেন।”

 বালিকা আর থাকিতে পারিল না, কাঁদিয়া উঠিল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, “আজ আমার মা সমস্ত দিন আহার করিতে পান নাই—”

 সকলে হাসিয়া উঠিল— তাহাদের নিষ্ঠুর অট্টহাস্যে গুহা প্রতিধ্বনিত হইল, বালিকার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল, কমল সভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিল। দস্যুদের হাস্য বজ্রধ্বনির ন্যায় বালিকার বক্ষে গিয়া বাজিল; সে সভয়ে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “আমাকে আমার মায়ের কাছে লইয়া যাও।”

 আবার সকলে মিলিয়া হাসিয়া উঠিল। ক্রমে তাহারা কমলের নিকট হইতে তাহার বাসস্থান, পিতামাতার নাম, প্রভৃতি জানিয়া লইল। অবশেষে একজন কহিল, “আমরা দস্যু, তুই আমাদের বন্দিনী। তোর মাতার নিকট বলিয়া পাঠাইতেছি, সে যদি নির্ধারিত অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না দেয় তবে তোকে মারিয়া ফেলিব।”

 কমল কাঁদিয়া কহিল, “আমার মা অর্থ কোথায় পাইবেন। তিনি অতি দরিদ্র। তাঁহার আর কেহ নাই— আমাকে মারিয়ো না, আমাকে মারিয়ো না, আমি কাহারও কিছু করি নাই।”

 আবার সকলে হাসিয়া উঠিল।

 কমলের মাতার নিকটে একজন দূত প্রেরিত হইল। সে গিয়া কহিল, “তোমার কন্যা বন্দিনী হইয়াছে—আজ হইতে তৃতীয় দিবসে আমি আসিব— যদি পাঁচশত মুদ্রা দিতে পারো তবে মুক্ত করিয়া দিব, নচেৎ তোমার কন্যা নিশ্চিত হত হইবে।”

 এই সংবাদ শুনিয়াই কমলের মাতা মূর্ছিত হইয়া পড়েন।