পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রবিবার
৭৮৭

বলিয়ে নিতে চায়, বিভা চুপ করে থাকে।

 জীবনের আরম্ভ থেকেই বিভা তার বাবারই মেয়ে সম্পূর্ণরূপে। এত ভালোবাসা, এত ভক্তি সে আর-কোনো মানুষকে দিতে পারে নি। তার বাপ সতীশও এই মেয়েটির উপরে তাঁর অজস্র স্নেহ ঢেলে দিয়েছেন। তাই নিয়ে ওর মার মনে একটু ঈর্ষা ছিল। বিভা হাঁস পুষেছিল, তিনি কেবলই খিট্‌খিট্ করে বলেছিলেন, ‘ওগুলো বড্ড বেশি ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ করে’। বিভা আসমানি রঙের শাড়ি জ্যাকেট করিয়েছিল, মা বলেছিলেন ‘এ কাপড় বিভার রঙে একটুও মানায় না’। বিভা তার মামাতো বোনকে খুব ভালোবাসত, তার বিয়েতে যেতে চাইলেই মা বলে বসলেন ‘সেখানে ম্যালেরিয়া’।

 মায়ের কাছ থেকে পদে পদে বাধা পেয়ে গেয়ে বাপের উপরে বিভার নির্ভর আরও গভীর এবং মজ্জাগত হয়ে গিয়েছিল।

 মার মৃত্যু হয় প্রথমেই। তার পরে ওর বাপের সেবা অনেক দিন পর্যন্ত ছিল বিভার জীবনের একমাত্র ব্রত। এই স্নেহশীল বাপের সমস্ত ইচ্ছাকে সে নিজের ইচ্ছা করে নিয়েছে। সতীশ তাঁর বিষয়সম্পত্তি দিয়ে গেছেন মেয়েকে। কিন্তু ট্রাস্টীর হাতে। নিয়মিত মাসহারা বরাদ্দ ছিল। মোট টাকাটা ছিল উপযুক্ত পাত্রের উদ্দেশে বিভার বিবাহের অপেক্ষায়। বাপের আদর্শে এই উপযুক্ত পাত্র কে তা বিভা জানত। অন্তত অনুপযুক্ত যে কে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। একদিন অভীক এ কথা তুলেছিল; বলেছিল, “যাঁকে তুমি কষ্ট দিতে চাও না তিনি তো নেই, আর কষ্ট যাকে নিষ্ঠুর ভাবে বাজে সেই লোকটাই আছে বেঁচে। হাওয়ায় তুমি ছুরি মারতে ব্যথা পাও, আর দরদ নেই এই রক্তমাংসের বুকের ’পরে।”

 শুনে বিভা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। অভীক বুঝেছিল ভগবানকে নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু বাবাকে নিয়ে নয়।


বেলা প্রায় দশটা। বিভার ভাইঝি সুস্মি এসে বললে, “পিসিমা, বেলা হয়েছে।”

 বিভা তার হাতে চাবির গোছা ফেলে দিয়ে বললে, “তুই ভাঁড়ার বের করে দে। আমি এখনি যাচ্ছি।”

 বেকারদের কাজের বাঁধা সীমা না থাকাতেই কাজ বেড়ে যায়। বিভার সংসারও সেই রকম। সংসারের দায়িত্ব আত্মীয়পক্ষে হালকা ছিল বলেই অনাত্মীয়পক্ষে হয়েছে বহু বিস্তৃত। এই ওর আপনগড়া সংসারের কাজ নিজের হাতে করাই ওর অভ্যাস চাকরবাকর পাছে কাউকে অবজ্ঞা করে। অভীক বললে, “অন্যায় হবে তোমার এখনই যাওয়া, কেবল আমার ’পরে নয়, সুস্মির ’পরেও। ওকে স্বাধীন কর্তৃত্বের সময় দাও না কেন। ডোমিনিয়ন স্টাটস, অন্তত আজকের মতো। তা ছাড়া আমি তোমাকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করতে চাই। কখনও তোমাকে কাজের কথা বলি নি, আজ বলে দেখব। নতুন অভিজ্ঞতা হবে।”

 বিভা বললে, “তাই হোক, বাকি থাকে কেন।”

 পকেট থেকে অভীক চামড়ার কেস বের করে খুলে দেখালে। একটা কবজিঘড়ি। ঘড়িটা প্লাটিনমের, সোনার মণিবন্ধ, হীরের টুকরোর ছিট দেওয়া। বললে, “তোমাকে বেচতে চাই।”

 “অবাক করেছ, বেচবে?”