পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮১২
গল্পগুচ্ছ

 “আপনি যতবার আমাকে আপনি বলেন, আমি মনে-মনে ততবার জিভ কাটতে থাকি। আমাকে তুমি যদি বলেন, তা হলে সেটাতেই যথার্থ আপনার স্নেহের সম্মান পাব। এ বাড়িতে আমাকে তুমি-শ্রেণীতে তুলে দিতে আপনার নাতনিও সাহায্য করবেন।”

 “সর্বনাশ! আমি সামান্য নাতনি, হঠাৎ অত উঁচুতে নাগাল পাব না, আপনি বড়োলোক। আমি বলি আর কিছুদিন যাক, যদি ভুলতে পারি আপনার ডিগ্রিধারী রূপ, তা হলে সবই সম্ভব হবে। কিন্তু দাদুর কথা স্বতন্ত্র। এখনই শুরু করো। দাদু, বলো তো, ‘তুমি কাল খেতে এসো, দিদি যদি মাছের ঝোলে নুন বেশি দিয়ে ফেলে, তা হলে ভালোমানুষের মতো সহ্য কোরো, বোলো, বাঃ কী চমৎকার, পাতে আরও একটু দিতে হবে।’”

 অধ্যাপক সস্নেহে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই, আর কিছুকাল আগে যদি আমার দিদিকে দেখতে, তা হলে বুঝতে পারতে আসলে ও লাজুক। সেইজন্যে ও যখন আলাপ করা কর্তব্য মনে করে, তখন জোর করতে গিয়ে কথা বেশি হয়ে পড়ে।”

 “দেখেছেন ডক্টর সেনগুপ্ত, দাদু আমাকে কী রকম মধুর করে শাসন করেন। যেন ইক্ষুদণ্ড দিয়ে। অনায়াসে বলতে পারতেন, তুমি বড়ো মুখরা, তোমার প্রগল্‌ভতা অত্যন্ত অসহ্য। আপনি কিন্তু আমাকে ডিফেন্‌ড্ করবেন। কী বলবেন, বলুন-না।”

 “আপনার মুখের সামনে বলব না।”

 “বেশি কঠোর হবে?”

 “আপনি জানেন আমার মনের কথা।”

 “তা হলে থাক্। এখন বাড়ি যান।”

 “একটা কথা বাকি আছে। কাল আপনাদের ওখানে যে নেমন্তন্ন সে আমার নতুন নামকরণের। কাল থেকে নবীনমাধব নাম থেকে লোপ পাবে ডাক্তার সেনগুপ্ত। সূর্যের কাছে আনাগোনা করতে গিয়ে ধূমকেতুর যেমন লেজটা যায় উড়ে, মুণ্ডটা থাকে বাকি।”

 “তা হলে নামকর্তন বলন, নামকরণ বলছেন কেন।”

 “আচ্ছা, তাই সই।”

 এইখানে শেষ হল আমার প্রথম বড়োদিন।

 বার্ধক্যের কী প্রশান্ত সৌন্দর্য, কী সৌম্য মূর্তি। চোখদুটি যেন আশীর্বাদ করছে। হাতে একটি পালিশ-করা লাঠি, গলায় শুভ্র পাট-করা চাদর, ধুতি যত্নে কোঁচানো, গায়ে তসরের জামা, মাথায় শুভ্র চুল বিরল হয়ে এসেছে, কিন্তু পরিপাটি করে আঁচড়ানো। স্পষ্ট বোঝা যায় এঁর সাজসজ্জায় এঁর দিনযাত্রায় নাতনির হাতের শিল্পকার্য। ইনি যে অতিলালনের অত্যাচার সহ্য করেন, সে কেবল এই মেয়েটিকে খুশি রাখবার জন্যে।

 আমার বৈজ্ঞানিক খবরকে ছাড়িয়ে উঠল, এঁদের খবর নেওয়া। অধ্যাপকের নাম ব্যবহার করব, অনিলকুমার সরকার। গত জেনেরেশনের কেম্‌ব্রিজ য়ুনিভার্‌সিটির পি. এইচ. ডি. দলের একজন। মাস কয়েক আগে একটি ঔপনাগরিক কলেজের