পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শেষ কথা
৮১৩

অধ্যক্ষতা ত্যাগ করে এখানকার স্টেটের একটা পরিত্যক্ত ডাকবাংলা ভাড়া নিয়ে নিজের খরচে সেটা বাসযোগ্য করেছেন। এইটে হল ইতিহাসের খসড়া, বাকিটুকু বঙ্কিমের চিঠি থেকে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে।


আমার গল্পের আদিপর্ব শেষ হয়ে গেল। ছোটোগল্পের আদি ও অন্তে বেশি ব্যবধান থাকে না। জিনিসটাকে ফলিয়ে বলবার লোভ করব না, ওর স্বভাব নষ্ট করতে চাই নে।

 অচিরার সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার যুগ এল সংক্ষেপেই। সেদিন চড়িভাতি হয়েছিল তনিকা নদীর তীরে।

 অধ্যাপক ছেলেমানুষের মতন হঠাৎ আমাকে জিগ্‌গেসা করে বসলেন, “নবীন, তোমার কী বিবাহ হয়েছে।”

 প্রশ্নটা এতই সুস্পষ্টভাবব্যঞ্জক যে আর কেউ হলে ওটা চেপে যেত। আমি উত্তর করলুম, “না, এখনও তো হয় নি।”

 অচিরার কাছে কোনো কথাই এড়ায় না। সে বললে, “দাদু, ঐ এখনও শব্দটা সংশয়গ্রস্ত কন্যাকর্তাদের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে। ওর কোনো যথার্থ মানে নেই।”

 “একেবারে মানে যে নেই, এ কথা নিশ্চিত স্থির করলেন কী করে।”

 “এটা গণিতের প্রব্লেম; তাও হাইয়ার ম্যাথম্যাটিক্‌স্ বললে যা বোঝায়, তা নয়। পূর্বেই শোনা গেছে, আপনি ছত্রিশ বছরের ছেলেমানুষ। হিসেব করে দেখলুম এর মধ্যে আপনার মা অন্তত পাঁচসাতবার আপনাকে বলেছেন, ‘বাবা, ঘরে বউ আনতে চাই।’ আপনি বলেছেন, ‘তার আগে চাই লোহার সিন্দুকে টাকা আনতে।’ মা চোখের জল মুছে চুপ করে রইলেন। তার পরে ইতিমধ্যে আপনার আর-সব হয়েছে, কেবল ফাঁসি ছিল বাকি। শেষকালে এখানকার রাজসরকারে যখন মোটা মাইনের পদ জুটেল, মা আবার বললেন, ‘বাবা, এবার বিয়ে করতে হবে, আমার আর কদিন বা সময় আছে।’ আপনি বললেন, ‘আমার জীবন আর আমার সায়াল্স্ এক, সে আমি দেশকে উৎসর্গ করব। আমি কোনোদিন বিয়ে করব না।’ হতাশ হয়ে আবার তিনি চোখের জল মুছে বসে আছেন। আপনার ছত্রিশ বছর বয়সের গণিতফল গণনা করতে আমার গণনায় ভুল হয়েছে কি না বলুন, সত্যি করে বলুন।”

 এ মেয়ের সঙ্গে অনবধানে কথা কওয়া বিপদ্‌জনক। কিছুদিন আগেই একটা ব্যাপার ঘটেছিল। প্রসঙ্গক্রমে অচিরা আমাকে বলেছিল, “আমাদের দেশে মেয়েদের আপনারা পান সংসারের সঙ্গিনীরূপে। সংসারে যাদের দরকার নেই, এ দেশের মেয়েরাও তাদের কাছে অনাবশ্যক। কিন্তু বিলেতে যারা বিজ্ঞানের তপস্বী, তাদের তো উপযুক্ত তপস্বিনী জোটে, যেমন ছিল অধ্যাপক কুরির সহধর্মিণী মাডাম কুরি। সে রকম কোনো মেয়ে আপনি সে দেশে থাকতে পান নি?”

 মনে পড়ে গেল ক্যাথারিনের কথা। এক সঙ্গে কাজ করেছি লণ্ডনে থাকতে। এমন-কি, আমার একটা রিসার্চের বইয়ে আমার নামের সঙ্গে তাঁর নামও জড়িত ছিল। মানতে হল কথাটা। অচিরা বললে, “তাঁকে আপনি বিয়ে করলেন না কেন। তিনি কি রাজি ছিলেন না।”