পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শেষ কথা
৮১৫

সম্রাট বড়ো বড়ো চোর। আসল কথা, তারাই ছিঁচকে চোর, ছাপ মারবার পূর্বেই যারা ধরা পড়ে।”

 অচিরা বললে, “ওঁর কত ছাত্র ওঁর মুখের কথা খাতার টুকে নিয়ে বই লিখে নাম করেছে। উনি তাদের লেখা পড়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশংসা করেন। জানতেই পারেন না নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন। আমার ভাগ্যে এ প্রশংসা প্রায়ই জোটে— নবীনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই উনি কবুল করবেন আমার ওরিজিন্যালিটির কথা খাতার লিখতে শুরু করেছেন, যে খাতায় তাম্রপ্রস্তরযুগের নোট রাখেন। মনে আছে, দাদু, অনেক দিনের কথা যখন কলেজে ছিলে, আমাকে কচ ও দেবযানীর কবিতা শুনিয়েছিলে? সেইদিন থেকে আমি পুরুষের উচ্চ গৌরব মনে মনে মেনেছি, কক্‌খনো মুখে স্বীকার করি নে।”

 “কিন্তু দিদি, আমার কোনো কথায় আমি মেয়েদের গৌরবের লাঘব করি নি।”

 “তুমি করবে? তুমি যে মেয়েদের অন্ধ ভক্ত, তোমার মুখের স্তবগান শুনে মনে মনে হাসি। মেয়েরা নির্লজ্জ হয়ে সব মেনে নেয়। সস্তার প্রশংসা আত্মসাৎ করা ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে।”

 সেদিন এই-যে কথাবার্তা হয়ে গেল, এ নেহাত হাস্যালাপ নয়। এর মধ্যে ছিল যুদ্ধের সূচনা। অচিরার স্বভাবের দুটো দিক ছিল, আর তার ছিল দুটো আশ্রয়—এক ছিল তাদের নিজেদের বাড়ি, আর ছিল সেই পঞ্চবটী। ওর সঙ্গে যখন আমার বেশ সহজ সম্বন্ধ হয়ে এসেছে তখন স্থির করেছিলুম, ঐ পঞ্চবটীর নিভৃতে হাসিকৌতুকের ছলে আমার জীবনের সদ্যসংকটের কথা কোনো রকম করে তুলব এবং নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাব। কিন্তু ওখানে পথ বন্ধ। আমাদের পরিচয়ের প্রথম দিনে প্রথম কথা যেমন মুখে আসছিল না, তেমনি এখানে যে অচিরা আছে তার কাছে প্রথম কথা নেই। মোকাবিলার ওর চরম মনের কথায় পৌঁছবার কোনো উপায় খুঁজে পাই নে। ওর ঘরের কাছে ওর সহাস্যমুখরতা রোধ করে দেয় আমার তরফের এক-পা অগ্রগতি আর ওর নিভৃত বনচ্ছায়ায় আমার সমস্ত চাঞ্চল্য ঠেকিয়ে রেখেছে নির্বাক্ নিঃশব্দতায়। কোনো-কোনোদিন ওদের ওখানে চায়ের নিমন্ত্রণসভার একটা কোনো সীমানায় মন খোলবার সুযোগ পাওয়া যায়, অচিরা বুঝতে পারে আমি বিপদ্‌মণ্ডলীর কাছাকাছি আসছি, সেই দিনই ওর বাক্যবাণবর্ষণের অবিরলতা অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠে। একটুও ফাঁক পাই নে, আর আবহাওয়াও হয়ে ওঠে প্রতিকূল। আমার মন হয়েছে অত্যন্ত অশান্ত; কাজের বাধা এমনি ঘটছে যে, আমি লজ্জা পাচ্ছি মনে মনে। সদরে বাজেটের মিটিঙে আমার রিসর্চ্‌বিভাগে আরও কিছু টাকা মঞ্জুর করে নেবার প্রস্তাব আছে, তারই সমর্থক রিপোর্ট্ অর্ধেকের বেশি লেখা হয় নি। ইতিমধ্যে ক্রোচের এস্‌থেটিক্‌স্‌ সম্বন্ধে আলোচনা রোজ কিছুদিন ধরে শুনে আসছি। বিষয়টা সম্পূর্ণ আমার উপলব্ধির এবং উপভোগের বাইরে— সে কথা অচিরা নিশ্চিত জানে। দাদুকে উৎসাহিত করে আর মনে মনে হাসে। সম্প্রতি চলছে Behaviourism সম্বন্ধে যত বিরুদ্ধ যুক্তি আছে তার ব্যাখ্যা। এই তত্ত্বালোচনার শোচনীয়তা হচ্ছে এই যে, অচিরা এই সময়টাতে ছুটি নিয়ে বাগানের কাজে চলে যায় বলে, ‘এ-সব তর্ক পূর্বেই শুনেছি।’ আমি বোকার মতো বসে থাকি মাঝে মাঝে দরজার দিকে তাকাই। একটা সুবিধে এই যে, অধ্যাপক জিজ্ঞাসা করেন না—