পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮১৬
গল্পগুচ্ছ

তর্কের কোনো একটা দুরূহ গ্রন্থি বুঝতে পারছি কি না। তাঁর মনে হয় সমস্তই জলের মতো বোঝা যায়।

 কিন্তু আর তো চলবে না, কোনো ছিদ্রে আসল কথাটা পাড়তেই হবে। পিক্‌নিকের এক অবকাশে অধ্যাপক যখন পোড়ো মন্দিরের সিঁড়িটাতে বসে নব্য কেমিস্ট্রির নতুন আমদানির বই পড়ছিলেন, বেঁটে আবলুস গাছের ঝোপের মধ্যে বসে অচিরা হঠাৎ আমাকে বললে, “এই চিরকালের বনের মধ্যে যে একটা অন্ধ প্রাণের শক্তি আছে, ক্রমেই তাকে আমার ভয় করছে।”

 আমি বললুম, “আশ্চর্য, ঠিক এই রকমের কথা সেদিন আমি আমার ডায়ারিতে লিখেছি।”

 আচরা বলে চলল, “পুরনো ইমারতের কোনো-একটা ফাটলে লুকিয়ে লুকিয়ে অশথের একটা অঙ্কুর ওঠে, তার পরে শিকড়ে শিকড়ে জড়িয়ে ধ’রে তার সর্বনাশ করে, এও তেমনি। দাদুর সঙ্গে এই কথাটাই হচ্ছিল। দাদু বলছিলেন, ‘লোকালয় থেকে বহুদিন একান্ত দূরে থাকলে মানবচিত্ত প্রকৃতির প্রভাবে দুর্বল হতে থাকে, প্রবল হয়ে ওঠে আদিম প্রাণপ্রকৃতির প্রভাব।’ আমি বললুম, ‘এ রকম অবস্থায় কী করা যায়?’ তিনি বললেন, ‘মানুষের চিত্তকে আমরা তো সঙ্গে করে আনতে পারি—ভিড়ের চেয়ে নির্জনে তাকে বরঞ্চ বেশি করে পাই, এই দেখো-না আমার বইগুলি।’ দাদুর পক্ষে বলা সহজ, কিন্তু সবাইকে এক ওষুধ খাটে না। আপনি কী বলেন।”

 আমি বললুম, “আচ্ছা বলব। আমার কথাটা ঠিকমত বুঝে দেখবেন। আমার মত এই যে, এই রকম জায়গায় এমন একজন মানুষের সঙ্গ সমস্ত অন্তর বাহিরে পাওয়া চাই, যার প্রভাব মানবপ্রকৃতিকে সম্পূর্ণ করে রাখতে পারে। যতক্ষণ না পাই ততক্ষণ অন্ধশক্তির কাছে কেবলই হার ঘটতে থাকবে। আপনি যদি সাধারণ মেয়েদের মতো হতেন, তা হলে আপনার কাছে সত্য কথা শেষপর্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে মুখে বাধত।”

 অচিরা বললে, “বলুন আপনি, দ্বিধা করবেন না।”

 বললাম, “আমি সায়ণ্টিস্ট্, যেটা বলতে যাচ্ছি সেটা ইম্পার্সোনাল ভাবে বলব।— আপনি একদিন ভবতোষকে অত্যন্ত ভালোবেসেছিলেন। আজও কি আপনি তাঁকে তেমনি ভালোবাসেন।”

 “আচ্ছা, মনে করুন, বাসি নে।”

 “আমিই আপনার মনকে সরিয়ে এনেছি।”

 “তা হতে পারে, কিন্তু একলা আপনি নন, বনের ভিতরকার এই ভীষণ অন্ধশক্তি। সেইজন্যে আমি এই সরে আসাকে শ্রদ্ধা করি নে, লজ্জা পাই।”

 “কেন করেন না।”

 “দীর্ঘকালের প্রয়াসে মানুষ চিত্তশক্তিতে নিজের আদর্শকে গড়ে তোলে, প্রাণশক্তির অন্ধতা তাকে ভাঙে! আপনার দিকে আমার যে ভালোবাসা সে সেই অন্ধশক্তির আক্রমণে।”

 “ভালোবাসাকে আপনি এমন করে গঞ্জনা দিচ্ছেন নারী হয়ে?”

 “নারী বলেই দিচ্ছি। ভালোবাসার আদর্শ আমাদের পূজার জিনিস। তাকেই বলে সতীত্ব। সতীত্ব একটা আদর্শ। এ জিনিসটা বনের প্রকৃতির নয়, মানবীর। এ