পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮১৮
গল্পগুচ্ছ

তার বিশ হাত দিনে দিনে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তখনই বিছানা ফেলে ছুটে গিয়ে ঝরনার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি স্নান করেছি।”

 এই কথা বলতে বলতে অচিরা ডাক দিলে, “দাদু!”

 অধ্যাপক তাঁর পড়া ফেলে রেখে কাছে এসে মধুর স্নেহে বললেন, “কী দিদি?”

 “তুমি সেদিন বলছিলে না, মানুষের সত্য তার তপস্যার ভিতর দিয়ে অভিব্যক্ত হয়ে উঠছে?— তার অভিব্যক্তি বায়োলজির নয়।”

 “হাঁ, তাই তো আমি বলি। পৃথিবীতে বর্বর মানুষ জন্তুর পর্যায়ে। কেবলমাত্র তপস্যার ভিতর দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ। আরও তপস্যা সামনে আছে, আরও স্থূলত্ব বর্জন করতে হবে, তবে সে হবে দেবতা। পুরাণে দেবতার কল্পনা আছে, কিন্তু অতীতে দেবতা ছিলেন না, দেবতা আছেন ভবিষ্যতে, মানুষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে।”

 “দাদু, এইবার তোমার আমার কথাটা চুকিয়ে দিই। কদিন থেকে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে।”

 আমি উঠে পড়ে বললুম, “তা হলে আমি যাই।”

 “না, আপনি বসুন। দাদু, তোমার সেই কলেজের যে অধ্যক্ষপদ তোমার ছিল, সেটা আবার খালি হয়েছে। সেক্রেটারি খুব অনুনয় করে তোমাকে লিখেছেন সেই পদ ফিরে নিতে। তুমি আমাকে সব চিঠি দেখাও, কেবল এই চিঠিটাই দেখাও নি। তাতেই তোমার দুরভিসন্ধি সন্দেহ করে ঐ চিঠিটা চুরি করে দেখেছি।”

 “আমারই অন্যায় হয়েছিল।”

 “কিছু অন্যায় হয় নি। আমি তোমাকে টেনে এনেছি তোমার আসন থেকে। আমরা কেবল নামিয়ে আনতেই আছি।”

 “কী বলছ দিদি!”

 “সত্যি কথাই বলছি। বিশ্বজগৎ না থাকলে বিধাতার হাত খালি হয়, ছাত্র না থাকলে তোমার তেমনি। সত্যি কথা বলো।”

 “বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করেছি কিনা তাই—”

 “তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! তুমি born teacher, তুমি আচার্য। তোমার জ্ঞানের সাধনা নিজের জন্যে নয়, অন্যকে দানের জন্যে। দেখেন নি নবীনবাবু?—মাথার একটা আইডিয়া এলে আমাকে নিয়ে পড়েন, দয়ামায়া থাকে না; বারো আনা বুঝতে পারি নে। নইলে আপনাকে নিয়ে বসেন, সে আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। আপনার মন যে কোন দিকে, বুঝতেই পারেন না, ভাবেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের দিকে। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই, কিন্তু বাছাই করে নিতে ভুলো না।”

 অধ্যাপক বললেন, “ছাত্রই তো শিক্ষককে বাছাই করে, গরজ তো তারই।”

 “আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। সম্প্রতি আমার চৈতন্য হয়েছে, যিনি শিক্ষক তাঁকে গ্রন্থকীট করে তুলছি। এমনি করে তপস্যা ভাঙি নিজের অন্ধ গরজে। সে কাজ তোমাকে নিতে হবে, এখনই যেতে হবে সেখানে ফিরে।”

 অধ্যাপক হতবুদ্ধির মতো অচিরার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। অচিরা বললে, “ও, বুঝেছি, তুমি ভাবছ আমার কী গতি হবে। আমার গতি তুমি। ভোলানাথ, আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয়, তা হলে দিদিমা দি সেকেণ্ডের আমদানি করতে