পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ল্যাবরেটরি
৮৩১

দেখা যায় বসন্তী রঙের কাঁচুলি। কপালে তার কুঙ্কুমের ফোঁটা, সূক্ষ্ম একটু কাজলের রেখা চোখে, কাঁধের কাছে ঝুলেপড়া গুচ্ছকরা খোঁপা, পায়ে কালো চামড়ার ’পরে লাল মখমলের কাজ করা স্যাণ্ডেল।

 যে আকাশনিম বীথিকার তলায় রেবতী রবিবার কাটায়, আগে থাকতে সংবাদ নিয়ে সোহিনী সেইখানে এসে তাকে ধরলে। প্রণাম করলে একেবারে তার পায়ে মাথা রেখে। বিষম ব্যস্ত হয়ে উঠল রেবতী।

 সোহিনী বললে, “কিছু, মনে কোরো না বাবা, তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে, আমি ছত্রির মেয়ে। চৌধুরীমশায়ের কাছে আমার কথা শুনে থাকবে।”

 “শুনেছি। কিন্তু এখানে আপনাকে বসাব কোথায়!”

 “এই-যে রয়েছে সবুজ তাজা ঘাস, এমন আসন কোথায় পাওয়া যায়! ভাবছ বোধ হয়, এখানে আমি কী করতে এসেছি। এসেছি আমার ব্রত উদ্‌যাপন করতে। তোমার মতো ব্রাহ্মণ তো খুঁজে পাব না।”

 রেবর্তী আশ্চর্য হয়ে বললে, “আমার মতো ব্রাহ্মণ!"

 “তা না তো কী। আমার গুরু বলেছেন, এখনকার কালের সব-সেরা যে বিদ্যা তাতেই যাঁর দখল তিনিই সেরা ব্রাহ্মণ।”

 রেবতী অপ্রস্তুত হয়ে বললে, “আমার বাবা করতেন যজন যাজন, আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি নে।”

 “বল কী, তুমি যে মন্ত্র শিখেছ সেই মন্ত্রে সমস্ত জগৎ হয়েছে মানুষের বশ। তুমি ভাবছ মেয়েমানুষের মুখে এ-সব কথা এল কোথা থেকে। পেয়েছি পুরুষের মতো পুরুষের মুখ থেকে। তিনি আমার স্বামী। যেখানে তাঁর সাধনার পীঠস্থান ছিল, কথা দাও বাবা, সেখানে তোমাকে যেতে হবে।”

 “কাল সকালে আমার ছুটি আছে, যাব।”

 “তোমার দেখছি গাছপালার শখ। বড়ো আনন্দ হল। গাছপালার খোঁজে আমার স্বামী গিয়েছিলেন বর্মায়, আমি তাঁর সঙ্গ ছাড়ি নি।”

 সঙ্গ ছাড়ে নি কিন্তু সায়েন্সের চর্চায় নয়। নিজের ভিতর থেকে যে গাদ উঠত ফুটে, স্বামীর চরিত্রের মধ্যেও সেটা অনুমান না করে থাকতে পারত না। সন্দেহের সংস্কার ছিল ওর আঁতে আঁতে। এক সময়ে নন্দকিশোরের যখন গুরুতর পীড়া হয়েছিল তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, “মরবার একমাত্র আরাম এই যে, সেখান থেকে তুমি আমাকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।”

 সোহিনী বললে, “সঙ্গে যেতে পারি তো।”

 নন্দকিশোর হেসে বললেন, “সর্বনাশ!”

 সোহিনী রেবতীকে বললে, “বর্মা থেকে আসবার সময় এনেছিলুম এক গাছের চারা। বর্মিজ্‌রা তাকে বলে ক্বোযাইটানিয়েঙ্গ্। চমৎকার ফলের শোভা— কিন্তু কিছুতেই বাঁচাতে পারলুম না।”

 আজই সকালে স্বামীর লাইব্রেরি ঘেঁটে এ নাম সোহিনী প্রথম বের করেছে। গাছটা চোখেও দেখে নি। বিদ্যার জাল ফেলে বিদ্বানকে টানতে চায়।

 অবাক হল রেবতী। জিগ্‌গেসা করলে, “এর লাটিন নামটা কী জানেন?”

 সোহিনী অনায়াসে বলে দিলে, “তাকে বলে মিলেটিয়া।”