পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ল্যাবরেটরি
৮৩৩

 নদীর ঘাট থেকে আস্তে আস্তে দেখা দিল নীলা। রোদ্‌দুর পড়েছে তার কপালে, তার চুলে। বেনারসি শাড়ির উপরে জরির রশ্মি ঝল্‌মল্ করে উঠছে। রেবতীর দৃষ্টি এক মূহূর্তের মধ্যে ওকে ব্যাপ্ত করে দেখে নিলে। চোখ নামিরে নিল পরক্ষণেই। ছেলেবেলা থেকে তার এই শিক্ষা। যে সুন্দরী মেয়ে মহামায়ার মনোহারিণী লীলা, তাকে আড়াল করে রেখেছে পিসির তর্জনী। তাই যখন সুযোগ ঘটে তখন দৃষ্টির অমৃত ওকে তাড়াতাড়ি এক চুমুকে গিলতে হয়।

 মনে মনে রেবতীকে ধিক্কার দিয়ে সোহিনী বললে, “দেখো দেখো, একবার চেয়ে দেখো।”

 রেবতী চমকে উঠে চোখ তুলে চাইলে।

 সোহিনী বললে, “দেখো তো ডক্টর অব সায়ান্স্, ওর শাড়ির রঙের সঙ্গে পাতার রঙের কী চমৎকার মিল হয়েছে!”

 রেবতী সসংকোচে বললে, “চমৎকার!”

 সোহিনী মনে মনে বললে, ‘নাঃ, আর পারা গেল না।’ আবার বললে, “ভিতরে বসন্তী রঙ উকি মাঁরছে, উপরে সবজে নীল।— কোন্ ফুলের সঙ্গে মেলে বলো দেখি।”

 উৎসাহ পেয়ে রেবতী ভালো করেই দেখলে। বললে, “একটা ফুল মনে পড়ছে, কিন্তু উপরের আবরণটা ঠিক নীল নয়, ব্রাউন।”

 “কোন ফুল বলো তো।”

 রেবতী বললে, “মেলিনা।”

 “ও, বুঝেছি। তার পাঁচটি পাপড়ি, একটি উজ্জ্বল হলদে, বাকি চারটে শ্যামবর্ণ।”

 রেবতী আশ্চর্য হয়ে গেল। বললে, “এত করে ফুলের পরিচয় জানলেন কী করে?”

 সোহিনী হেসে বললে, “জানা উচিত হয় নি বাবা! পুজোর সাজির বাইরের ফুল আমাদের কাছে পরপুরুষ বললেই হয়।”

 ডালি হাতে এল ধীরে ধীরে নীলা। মা বললে, “জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? পা ছুঁয়ে প্রণাম কর্।”

 “থাক্, থাক্‌” ব’লে রেবতী অস্থির হয়ে উঠল। রেবতী আসন করে বসেছিল, পা খুঁজে বের করতে নীলাকে একটু হাতড়াতে হল। শিউরে উঠল রেবতীর সমস্ত শরীর। ডালিতে ছিল দুর্লভ-জাতীয় অর্কিডের মঞ্জরি, রুপোর থালায় ছিল বাদামের তক্তি, পেস্তার বরফি, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, মালাইয়ের বরফি, চৌকো করে কাটা কাটা ভাপা দই।

 বললে, “এ সমস্তই তৈরি নীলার নিজের হাতে।”

 সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। এ-সব কাজে নীলার না ছিল হাত, না ছিল মন।

 সোহিনী বললে, “একটু মুখে দিতে হয় বাবা, ঘরে তৈরি তোমারই উদ্দেশে।”

 ফরমাশে তৈরি বড়োবাজারের এক চেনা দোকানে।

 রেবতী হাত জোড় করে বললে, “এ সময়ে খাওয়া আমার অভ্যাস নয়। বরং অনুমতি করেন বদি, বাসায় নিয়ে যাই।”