পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৩৮
গল্পগুচ্ছ

একটি শব্দের মিল আছে, বড়ো খাঁটি তার অর্থ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হিনি হিনি কিনি কিনি রবে ঐ দুটি শব্দ মিলিয়ে মনে মনে খঞ্জনি বাজাতে থাকি।”

 “কেমিস্ট্রির রিসর্চে মিল করা আপনার অভ্যাস আছে, ওটা তারই একটা ফেঁকড়া।”

 “মিল করতে গিয়ে মরেও অনেক লোক। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে নেই— ঘোরতর দাহ্য পদার্থ।”

 এই বলে হাঃ হাঃ শব্দে উচ্চহাস্য করে উঠলেন।

 “নাঃ, ঐ ছোকরাটার সামনে এ-সব কথার আলোচনা করতে নেই। বারুদের কারখানায় আজ পর্যন্ত ও অ্যাপ্রেণ্টিসি শুরু করে নি। পিসিমার আঁচল ওকে আগলে আছে, সে আঁচল নন্‌কম্‌বাস্‌টিব্‌ল্।”

 রেবতীর মেয়েলী মুখ লাল হয়ে উঠছিল।

 “সোহিনী, আমি তোমাকে জিগ্‌গেসা করতে যাচ্ছিলাম, আজ সকালে তুমি কি ওকে আফিম খাইয়ে দিয়েছিলে। অমন ঝিমিয়ে পড়ছে কেন।”

 “খাইয়ে যদি থাকি সেটা না জেনে।”

 “রেবু, ওঠ্ বলছি ওঠ্। মেয়েদের কাছে অমন মুখচোরা হয়ে থাকতে নেই। ওতে ওদের আম্পর্ধা বেড়ে যায়। ওরা তো ব্যামোর মতো পুরুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়, ছিদ্র পেলেই টেম্পরেচর চড়িয়ে দেয় হু হু করে। সাবজেক্ট্‌টা জানা আছে, ছেলেগুলোকে সাবধান করতে হয়। আমার মতো যারা ঘা খেয়েছে, মরে নি, তাদের কাছ থেকেই পাঠ নিতে হয়। রেবু, কিছু মনে করিস নে বাবা! যারা কথা কয় না, চুপ করে থাকে, তারাই সব চেয়ে ভয়ংকর। চল, দেখি, তোকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ঐ দেখ দুটো গ্যাল ভানোমিটর, একেবারে হাল কায়দার। এই দেখ্‌ হাই ভ্যাকুয়ম পম্প্, আর এটা মাইক্রোফোটোমিটর, এ ছেলে-পাস-করাবার কলার ভেলা নয়। একবার এখানে আসন গেড়ে বোস্ দেখি। সেই তোমার টাক-পড়া মাথার প্রোফেসর—নাম করতে চাই নে— দেখি কেমন তার মুখ চুন হয়ে না যায়। আমার ছাত্র হয়ে যখন তুই বিদ্যে শুরু করলি আমি তোকে বলি নি কি তোর নাকের সামনে ঝুলছে যাকে কথায় বলে ‘ভবিষ্যৎ’? হেলাফেলা করে সেটাকে ফোঁপরা করে দিস নে যেন। তোর জীবনীর প্রথম চ্যাপ্টারের এক কোণে আমার নামটাও ছোটো অক্ষরে লেখা যদি থাকে, সেটা হবে আমার মস্ত গুরুদক্ষিণা।”

 দেখতে দেখতে বিজ্ঞানী জেগে উঠল। জ্বলে উঠল তার দুই চোখ। চেহারাটা একেবারে ভিতর থেকে গেল বদলে। মুগ্ধ হয়ে সোহিনী বললে, “তোমাকে যে-কেউ জানে, তারা সকলেই তোমার এত বড়ো উন্নতির আশা করে যা প্রতিদিনের জিনিস নয়, যা চিরদিনের। কিন্তু আশা যতই বড়ো, ততই বড়ো তার বাধা ভিতরে বাইরে।”

 অধ্যাপক রেবতীর পিঠে আর একবার দিলে একটা মস্ত চাপড়। ঝন্‌ঝন্ করে উঠল তার শিরদাঁড়া। চৌধুরী তাঁর মস্ত ভারী গলায় বললেন, “দেখ্‌ রেবু, যে মহৎ ভবিষ্যতের বাহন হওয়া উচিত ছিল ঐরাবত, কৃপণ বর্তমান চাপিয়ে দেয় তাকে গোরুর গাড়িতে, কাদার পড়ে থাকে সে অচল হয়ে। শুনছ সোহিনী, সুহি?— না না ভয় নেই, পিঠে চাপড় মারব না। বলো সত্যি করে, কথাটা আমি কেমন গুছিয়ে বলেছি।”