পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬২
গল্পগুচ্ছ

দিই না।

 এখনকার কালের ছোঁয়াচ আমাকে লাগিয়াছে। আমি গীতা পড়িয়া থাকি এবং বিদ্বান লােকদের দ্বারস্থ হইয়া তাহাদের কাছে ধর্মতত্ত্বের অনেক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা শুনিয়াছি। কেবল শুনিয়া শুনিয়াই বয়স বহিয়া যাইবার জো হইল, কোথাও তাে কিছু প্রত্যক্ষ দেখিলাম না। এতদিন পরে নিজের দৃষ্টির অহংকার ত্যাগ করিয়া এই শাস্ত্রহীনা স্ত্রীলােকের দুই চক্ষুর ভিতর দিয়া সত্যকে দেখিলাম। ভক্তি করিবার ছলে শিক্ষা দিবার এ কী আশ্চর্য প্রণালী।

 পরদিন সকালে বােষ্টমী আসিয়া আমাকে প্রণাম করিয়া দেখিল, তখনো আমি লিখিতে প্রবত্ত। বিরক্ত হইয়া বলিল, “তােমাকে আমার ঠাকুর এত মিথ্যা খাটাইতেছেন কেন। যখনি আসি দেখিতে পাই লেখা লইয়াই আছ!”

 আমি বলিলাম, “যে লােকটা কোনাে কর্মেরই নয় ঠাকুর তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেন না, পাছে সে মাটি হইয়া যায়। যত রকমের বাজে কাজ করিবার ভার তাহারই উপরে।”

 আমি যে কত আবরণে আবৃত তাহাই দেখিয়া সে অধৈর্য হইয়া উঠে। আমার সঙ্গে দেখা করিতে হইলে অনুমতি লইয়া দোতলায় চড়িতে হয়, প্রণাম করিতে আসিয়া হাতে ঠেকে মােজাজোড়া, সহজ দুটো কথা বলা এবং শােনার প্রয়ােজন কিন্তু আমার মনটা কোন্ লেখার মধ্যে তলাইয়া।

 হাত জোড় করিয়া সে বলিল, “গৌর, আজ ভােরে বিছানায় যেমনি উঠিয়া বসিয়াছি অমনি তােমার চরণ পাইলাম। আহা, সেই তােমার দুখানি পা, কোনাে ঢাকা নাই—সে কী ঠাণ্ডা। কী কোমল। কতক্ষণ মাথায় ধরিয়া রাখিলাম। সে তাে খুব হইল। তবে আর আমার এখানে আসিবার প্রয়ােজন কী। প্রভু, এ আমার মােহ নয় তাে? ঠিক করিয়া বলো।”

 লিখিবার টেবিলের উপর ফুলদানিতে পূর্বদিনের ফুল ছিল। মালী আসিয়া সেগুলি তুলিয়া লইয়া নূতন ফুল সাজাইবার উদ্‌যােগ করিল।

 বােষ্টমী যেন ব্যথিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “বাস? এ ফুলগুলি হইয়া গেল? তােমার আর দরকার নাই? তবে দাও দাও, আমাকে দাও।”

 এই বলিয়া ফুলগুলি অঞ্জলিতে লইয়া, কতক্ষণ মাথা নত করিয়া, একান্ত স্নেহে এক দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিয়া বলিল, “তুমি চাহিয়া দেখ না বলিয়াই এ ফুল তােমার কাছে মলিন হইয়া যায়। যখন দেখিবে তখন তােমার লেখাপড়া সব ঘুচিয়া যাইবে।”

 এই বলিয়া সে বহু যত্নে ফুলগুলি আপন আঁচলের প্রান্তে বাঁধিয়া লইয়া মাথায় ঠেকাইয়া বলিল, “আমার ঠাকুরকে আমি লইয়া যাই।”

 কেবল ফুলদানিতে রাখিলেই যে ফুলের আদর হয় না, তাহা বুঝিতে আমার বিলম্ব হইল না। আমার মনে হইল, ফুলগুলিকে যেন ইস্কুলের পড়া-না-পারা ছেলেদের মতাে প্রতিদিন আমি বেঞ্চের উপর দাঁড় করাইয়া রাখি।

 সেইদিন সন্ধ্যার সময় যখন ছাদে বসিয়াছি বােষ্টমী আমার পায়ের কাছে আসিয়া বসিল। কহিল, “আজ সকালে নাম শুনাইবার সময় তােমার প্রসাদী ফুলগুলি ঘরে ঘরে দিয়া আসিয়াছি। আমার ভক্তি দেখিয়া বেণী চক্রবর্তী হাসিয়া বলিল, ‘পাগলি,