পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বােষ্টমী
৬৬৩

কাকে ভক্তি করিস তুই? বিশ্বের লােকে যে তাকে মন্দ বলে।’ হাঁগাে, সকলে নাকি তােমাকে গালি দেয়?”

 কেবল এক মুহূর্তের জন্য মনটা সংকুচিত হইয়া গেল। কালীর ছিটা এত দুরেও ছড়ায়!

 বােষ্টমী বলিল, “বেণী ভাবিয়াছিল, আমার ভক্তিটাকে এক ফুঁয়ে নিবাইয়া দিবে। কিন্তু, এ তাে তেলের বাতি নয়, এ যে আগুন! আমার গৌর, ওরা তােমাকে গালি দেয় কেন গাে।”

 আমি বলিলাম, “আমার পাওনা আছে বলিয়া। আমি হয়তাে একদিন লুকাইয়া উহাদের মন চুরি করিবার লােভ করিয়াছিলাম।”

 বােষ্টমী কহিল, “মানুষের মনে বিষ যে কত সে তাে দেখিলে। লােভ আর টিঁকিবে না।”

 আমি বলিলাম, “মনে লােভ থাকিলেই মারের মুখে থাকিতে হয়। তখন নিজেকে মারিবার বিষ নিজের মনই জোগায়। তাই আমার ওঝা আমারই মনটাকে নির্বিষ করিবার জন্য এত কড়া করিয়া ঝাড়া দিতেছেন।”

 বােষ্টমী কহিল, “দয়াল ঠাকুর মারিতে মারিতে তবে মারকে খেদান। শেষ পর্যন্ত যে সহিতে পারে সেই বাঁচিয়া যায়।”

 সেইদিন সন্ধ্যার সময় অন্ধকার ছাদের উপর সন্ধ্যাতারা উঠিয়া আবার অস্ত গেল; বােষ্টমী তাহার জীবনের কথা আমাকে শুনাইল।


 আমার স্বামী বড়ো সাদা মানুষ। কোনাে কোনাে লােকে মনে করিত, তাঁহার বুঝিবার শক্তি কম। কিন্তু, আমি জানি, যাহারা সাদা করিয়া বুঝিতে পারে তাহারাই মােটের উপর ঠিক বােঝে।

 ইহাও দেখিয়াছি, তাঁহার চাষবাস জমিজমার কাজে তিনি যে ঠকিতেন তাহা নহে। বিষয়কাজ এবং ঘরের কাজ দুইই তাঁহার গােছালাে ছিল। ধান-চাল-পাটের সামান্য যে একটু ব্যাবসা করিতেন কখনাে তাহাতে লােকসান করেন নাই। কেননা, তাঁহার লােভ অল্প। যেটুকু তাঁহার দরকার সেটুকু তিনি হিসাব করিয়া চলিতেন; তার চেয়ে বেশি যা তাহা তিনি বুঝিতেনও না, তাহাতে হাতও দিতেন না।

 আমার বিবাহের পূবেই আমার শ্বশুর মারা গিয়াছিলেন এবং আমার বিবাহের অল্পদিন পরেই শাশুড়ির মৃত্যু হয়। সংসারে আমাদের মাথার উপরে কেহই ছিল না।

 আমার স্বামী মাথার উপরে একজন উপরওয়ালাকে না বসাইয়া থাকিতে পারিতেন না। এমন-কি, বলিতে লজ্জা হয়, আমাকে যেন তিনি ভক্তি করিতেন। তবু আমার বিশ্বাস, তিনি আমার চেয়ে বুঝিতেন বেশি, আমি তাঁহার চেয়ে বলিতাম বেশি।

 তিনি সকলের চেয়ে ভক্তি করিতেন তাঁহার গুরুঠাকুরকে। শুধু ভক্তি নয়, সে ভালােবাসা—এমন ভালােবাসা দেখা যায় না।

 গুরুঠাকুর তাঁর চেয়ে বয়সে কিছু কম। কী সুন্দর রূপ তাঁর।