পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শেষের রাত্রি
৬৯৯

 “টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ্ করা হয়ে গেছে।”

 “তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে—তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো—আজ যেয়ো না।”

 “মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী।”

 “যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে।”

 “বেশ তো, এখনো সময় আছে—আমি তাঁকে বলে আসছি।”

 “না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ।”

 “তা বেশ, কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না। কালই অন্নপ্রাশন—আজ যদি না যাই তো চলবে না।”

 “আমি জোড়হাত করছি বউ, আমার কথা আজ এক দিনের মতো রাখো। আজ মন একটু শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বোসো—তাড়াতাড়ি কোরো না।”

 “তা, কী করব বলো, গাড়ি তো আমার জন্য বসে থাকবে না। অনাথ চলে গেছে—দশ মিনিট পরে সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।”

 “না, তবে থাক্—তুমি যাও। এমন করে তার কাছে যেতে দেব না। ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে—কিন্তু, যত দিন বেঁচে থাকবি এ দিনের কথা তোকে চিরদিন মনে রাখতে হবে—ভগবান আছেন, ভগবান আছেন, সে কথা একদিন বুঝবি।”

 “মাসি, তুমি অমন ক’রে শাপ দিয়ো না বলছি।”

 “ওরে বাপ রে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ! পাপের যে শেষ নেই—আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না।”


মাসি একটু দেরি করিয়া রোগীর ঘরে গেলেন। আশা করিলেন যতীন ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু, ঘরে ঢুকিতেই দেখিলেন, বিছানার উপর যতীন নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। মাসি বললেন, “এই এক কাণ্ড ক’রে বসেছে।”

 “কী হয়েছে। মণি এল না? এত দেরি করলে কেন, মাসি।”

 “গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি, হয়েছে কি, আরও তো দুধ আছে। কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধে পুড়িয়ে ফেলেছে, বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না। আমি তাকে অনেক ঠাণ্ডা করে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি। আজ আর তাকে আনলুম না। সে একটু ঘুমোক।”

 মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যানমাধুরীটুকুর প্রতি জুলম করিয়া যায়। কেননা, তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া ভরিয়া উঠিতে লাগিল।

 “মাসি!”

 “কী বাবা।”