পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭২৬
গল্পগুচ্ছ

খাঁটি নৈমিষারণ্য আবিষ্কার করিয়াছে। এই আবিষ্কারটা যে সত্য তার প্রধান প্রমাণ, ইহা কৃষ্ণপ্রতিপদের ভােরবেলায় স্বপ্নে প্রকাশ পাইয়াছে। স্বয়ং সরস্বতী ফাঁস করিয়া দিয়াছেন। তিনি যদি নিজবেশে আসিয়া আবির্ভূত হইতেন তাহা হইলে বরঞ্চ সন্দেহের কারণ থাকিত—কিন্তু, তিনি তাঁর আশ্চর্য দেবলীলায় হাঁড়িচাঁচা পাখি হইয়া দেখা দিলেন। পাখির লেজে তিনটি মাত্র পালক ছিল—একটি সাদা, একটি সবুজ, মাঝেরটি পাটকিলে। এই পালক তিনটি যে সত্ত্ব রজ তম, ঋক্ যজুঃ সাম, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়, আজ কাল পরশু প্রভৃতি যে তিন সংখ্যার ভেল্কি লইয়া এই জগৎ তাহারই নিদর্শন তাহাতে সন্দেহ ছিল না। তার পর হইতে এই নৈমিষারণ্যে যােগী তৈরি হইতেছে। দুইজন এম.এস্‌সি. ক্লাসের ছেলে কলেজ ছাড়িয়া এখানে যােগ অভ্যাস করেন; একজন সাবজজ তাঁর সমস্ত পেন্সেন এই নৈমিষারণ্য-ফণ্ডে উৎসর্গ করিয়াছেন এবং তাঁহার পিতৃমাতৃহীন ভাগনেটিকে এখানকার যােগী ব্রহ্মচারীদের সেবার জন্য নিযুক্ত করিয়া দিয়া মনে আশ্চর্য শান্তি পাইয়াছেন।

 এই নৈমিষারণ্য হইতে ষােড়শীর জন্য যােগ-অভ্যাসের শিক্ষক পাওয়া গেল। সুতরাং মাখনকে নৈমিষারণ্য-কমিটির গৃহী-সভ্য হইতে হইল। গৃহী-সভ্যের কর্তব্য, নিজের আয়ের ষষ্ঠ অংশ সন্ন্যাসী-সভ্যদের ভরণপােষণের জন্য দান করা। গৃহীসভ্যদের শ্রদ্ধার পরিমাণ-অনুসারে এই ষষ্ঠ অংশ অনেক সময় থার্মোমিটরের পারার মতাে সত্য অঙ্কটার উপরে নীচে উঠানামা করে। অংশ কষিবার সময় মাখনেরও ঠিকে ভুল হইতে লাগিল। সেই ভুলটার গতি নীচের অঙ্কের দিকে। কিন্তু, এই ভুলচুকে নৈমিষারণ্যের যে ক্ষতি হইতেছিল ষােড়শী তাহা পুরণ করিয়া দিল। ষােড়শীর গহনা আর বড়োকিছু বাকি রহিল না এবং তার মাসহারার টাকা প্রতি মাসে সেই অন্তর্হিত গহনাগুলাের অনুসরণ করিল।

 বাড়ির ডাক্তার অনাদি আসিয়া মাখনকে কহিলেন, “দাদা, করছ কী। মেয়েটা যে মারা যাবে।”

 মাখন উদ্‌বিগ্ন মুখে বলিলেন, “তাই তাে, কী করি।”

 যােড়শীর কাছে তাঁর আর সাহস নাই। এক সময়ে অত্যন্ত মৃদুস্বরে তাকে আসিয়া বলিলেন, “মা, এত অনিয়মে কি তােমার শরীর টিঁকবে।”

 ষোড়শী একটুখানি হাসিল। তার মর্মার্থ এই, এমন-সকল বৃথা উদ্‌বেগ সংসারী বিষয়ী লোকেরই যােগ্য বটে।

বরদা চলিয়া যাওয়ার পরে বারাে বৎসর পার হইয়া গেছে; এখন যােড়শীর বয়স পঁচিশ। একদিন ষোড়শী তার যােগী শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, আমার স্বামী জীবিত আছেন কি না তা আমি কেমন করে জানব।”

 যােগী প্রায় দশ মিনিট কাল স্তব্ধ হইয়া চোখ বুজিয়া রহিলেন; তার পরে চোখ খুলিয়া বলিলেন, “জীবিত আছেন।”

 “কেমন ক’রে জানলেন।”

 “সে কথা এখনাে তুমি বুঝবে না। কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনাে, স্ত্রীলােক হয়েও