সাধনার পথে তুমি যে এতদূর অগ্রসর হয়েছ সে কেবল তােমার স্বামীর অসামান্য তপােবলে। তিনি দূরে থেকেও তােমাকে সহধর্মিণী করে নিয়েছেন।”
ষোড়শীর শরীর-মন পুলকিত হইয়া উঠিল। নিজের সম্বন্ধে তার মনে হইল, ঠিক যেন শিব তপস্যা করিতেছেন আর পার্বতী পদ্মবীজের মালা জপিতে জপিতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করিয়া আছেন।
ষােড়শী আবার জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি কোথায় আছেন তা কি জানতে পারি।”
যােগী ঈষৎ হাস্য করিলেন; তার পরে বলিলেন, “একখানা আয়না নিয়ে এসাে।”
ষোড়শী আয়না আনিয়া যােগীর নির্দেশমত তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল।
আধ ঘণ্টা গেলে যােগী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু দেখতে পাচ্ছ?”
ষোড়শী দ্বিধার ঘরে কহিল, “হাঁ, যেন কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কী তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি নে।”
“সাদা কিছু দেখছ কি।”
“সাদাই তাে বটে।”
“যেন পাহাড়ের উপর বরফের মতাে?”
“নিশ্চয়ই বরফ! কখনাে পাহাড় তাে দেখি নি, তাই এতক্ষণ ঝাপসা ঠেকছিল।”
এইরপ আশ্চর্য উপায়ে ক্রমে ক্রমে দেখা গেল, বরদা হিমালয়ের অতি দুর্গম জায়গায় লংচু পাহাড়ে বরফের উপর অনাবৃত দেহে বসিয়া আছেন। সেখান হইতে তপস্যার তেজ ষোড়শীকে আসিয়া স্পর্শ করিতেছে, এই এক আশ্চর্য কাণ্ড।
সেদিন ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া ষোড়শীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। তার স্বামীর তপস্যা যে তাকে দিনরাত ঘেরিয়া আছে, স্বামী কাছে থাকিলে মাঝে মাঝে যে বিচ্ছেদ ঘটিতে পারিত সে বিচ্ছেদও যে তার নাই, এই আনন্দে তার মন ভরিয়া উঠিল। তার মনে হইল, সাধনা আরও অনেক বেশি কঠোর হওয়া চাই। এতদিন এবং পৌষ মাসটাতে যে কম্বল সে গায়ে দিতেছিল এখনি সেটা ফেলিয়া দিতেই শীতে তার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল। ষোড়শীর মনে হইল, সেই লংচু পাহাড়ের হাওয়া তার গায়ে আসিয়া লাগিতেছে। হাত জোড় করিয়া চোখ বুজিয়া সে বসিয়া রহিল, চোখের কোণ দিয়া অজস্র জল পড়িতে লাগিল।
সেইদিনই মধ্যাহ্নে আহারের পর মাখন ষােড়শীকে তাঁর ঘরে ডাকিয়া আনিয়া বড়ােই সংকোচের সঙ্গে বলিলেন, “মা, এতদিন তােমার কাছে বলি নি, ভেবেছিলাম দরকার হবে না, কিন্তু আর চলছে না। আমার সম্পত্তির চেয়ে আমার দেনা অনেক বেড়েছে, কোনদিন আমার বিষয় ক্রোক করে বলা যায় না।”
যােড়শীর মুখে আনন্দে দীপ্ত হইয়া উঠিল। তার মনে সন্দেহ রহিল না যে, এ-সমস্তই তার স্বামীর কাজ। তার স্বামী তাকে পূর্ণভাবে আপন সহধর্মিণী করিতেছেন—বিষয়ের যেটুকু ব্যবধান মাঝে ছিল সেও কি এবার ঘুচাইলেন! কেবল উত্তরে হাওয়া নয়, এই-যে দেনা এও সেই লংচু পাহাড় হইতে আসিয়া পৌঁছিতেছে। এ তার স্বামীরই দক্ষিণ হাতের স্পর্শ।
সে হাসিমুখে বলিল, “ভয় কী বাবা!”
মাখন বলিলেন, “আমরা দাঁড়াই কোথায়।”
ষোড়শী বলিল, “নৈমিষারণ্যে চালা বেঁধে থাকব।”