পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৭৬
গল্পগুচ্ছ

চোরাই ধন

মহাকাব্যের যুগে স্ত্রীকে পেতে হত পৌরুষের জোরে; যে অধিকারী সেই লাভ করত রমণীরত্ন। আমি লাভ করেছি কাপুরুষতা দিয়ে, সে কথা আমার স্ত্রীর জানতে বিলম্ব ঘটেছিল। কিন্তু, সাধনা করেছি বিবাহের পরে; যাকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পেয়েছি তার মূল্য দিয়েছি দিনে দিনে।

 দাম্পত্যের স্বত্ব সাব্যস্ত করতে হয় প্রতিদিনই নতুন ক’রে, অধিকাংশ পুরুষ ভুলে থাকে এই কথাটা। তারা গোড়াতেই কাস্টম হৌসে মাল খালাস ক’রে নিয়েছে সমাজের ছাড়চিঠি দেখিয়ে, তার পর থেকে আছে বেপরোয়া। যেন পেয়েছে পাহারওয়ালার সরকারি প্রতাপ উপরওয়ালার দেওয়া তকমার জোরে; উর্দিটা খুলে নিলেই অতি অভাজন তারা।

 বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়ে। এই কথাটা ভালোরকম করে বুঝেছি সুনেত্রার কাছ থেকেই। ওর মধ্যে আছে ভালোবাসার ঐশ্বর্য, ফুরোতে চায় না তার সমারোহ; দেউড়িতে চার-প্রহর বাজে তার সাহানা রাগিণী। আপিস থেকে ফিরে এসে একদিন দেখি আমার জন্যে সাজানো আছে বরফ-দেওয়া ফল্‌সার সরবৎ, রঙ দেখেই মনটা চমকে ওঠে; তার পাশেই ছোটো রুপোর থালায় গোড়ে মালা, ঘরে ঢোকবার আগেই গন্ধ আসে এগিয়ে। আবার কোনোদিন দেখি আইস্‌ক্রীমের যন্ত্রে জমানো, শাঁসে রসে মেশানো, তালশাঁস এক-পেয়ালা, আর পিরিচে একটিমাত্র সসূর্যমুখী। ব্যাপারটা শুনতে বেশি কিছু নয়, কিন্তু বোঝা যায় দিনে দিনে নতুন ক’রে সে অনুভব করেছে আমার অস্তিত্ব। এই পুরোনোকে নতুন ক’রে অনুভব করার শক্তি আর্টিস্টের। আর ‘ইতরে জনাঃ’ প্রতিদিন চলে দস্তুরের দাগা বুলিয়ে। ভালোবাসার প্রতিভা সুনেত্রার, নবনবোন্মেষশালিনী সেবা। আজ আমার মেয়ে অরণার বয়স সতেরো, অর্থাৎ ঠিক যে বয়সে বিয়ে হয়েছিল সুনেত্রার। ওর নিজের বয়স আটত্রিশ, কিন্তু সযত্নে সাজসজ্জা করাটাকে ও জানে প্রতিদিন পুজোর নৈবেদ্য-সাজানো, আপনাকে উৎসর্গ করবার আহ্নিক অনুষ্ঠান।

 সুনেত্রা ভালোবাসে শান্তিপুরে সাদা শাড়ি কালো-পাড়-ওয়ালা। খদ্দরপ্রচারকদের ধিক্কারকে বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে নিয়েছে, কিছুতেই স্বীকার করে নি খদ্দরকে। ও বলে, ‘দিশি তাঁতির হাত, দিশি তাঁতির তাঁত, এই আমার আদরের। তারা শিল্পী, তাদেরই পছন্দে সুতো, আমার পছন্দ সমস্ত কাপড়টা নিয়ে।’ আসল কথা, সুনেত্রা বোঝে হালকা সাদা রঙের শাড়িতে সকল রঙেরই ইশারা খাটে সহজে। ও সেই কাপড়ে নূতনত্ব দেয় নানা আভাসে, মনে হয় না সেজেছে। ও বোঝে, আমার অবচেতন মনের দিগন্ত উদ্ভাসিত হয় ওর সাজে— আমি খুশি হই, জানি নে কেন খুশি হয়েছি।

 প্রত্যেক মানষেই আছে একজন আমি, সেই অপরিমেয় রহস্যের অসীম মূল্য জোগায় ভালোবাসায়। অহংকারের মেকি পয়সা তুচ্ছ হয়ে যায় এর কাছে। সুনেত্রা আপন মনপ্রাণ দিয়ে এই পরম মূল্য দিয়ে এসেছে আমাকে, আজ একুশ বছর ধ’রে।