পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪৮
গল্পগুচ্ছ

“বড়াে হইবার পথের দুঃখ এখন হইতেই শুরু হইল। কিন্তু গােপন করিবার দরকার নাই। কারণ, ইহার রহস্য কেবল একজনমাত্রই ভেদ করিতে পারিবে, হাজার চেষ্টা করিলেও আর-কেহ তাহা পারিবে না। তােমাদের মধ্যে সেই লােকটি যে কে, তাহা কেহ জানে না। অতএব ইহা সকলের সম্মুখেই নির্ভয়ে খুলিয়া রাখিতে পার।”

 সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন। কিন্তু, হরিহর এ কাগজটি লুকাইয়া না রাখিয়া থাকিতে পারিল না। পাছে আর-কেহ ইহা হইতে লাভবান হয়, পাছে তাহার ছােটো ভাই শংকর ইহার ফলভােগ করিতে পারে, এই আশঙ্কায় হরিহর এই কাগজটি একটি কাঁঠালকাঠের বাক্সে বন্ধ করিয়া তাহাদের গৃহদেবতা জয়কালীর আসনতলে লকাইয়া রাখিল। প্রত্যেক অমাবস্যায় নিশীথরাত্রে দেবীর পূজা সারিয়া সে একবার করিয়া সেই কাগজটি খুলিয়া দেখিত, যদি দেরী প্রসন্ন হইয়া তাহাকে অর্থ বুঝিবার শক্তি দেন।

 শংকর কিছুদিন হইতে হরিহরকে মিনতি করিতে লাগিল, “দাদা, আমাকে সেই কাগজটা একবার ভালাে করিয়া দেখিতে দাও-না।”

 হরিহর কহিল, “দুর পাগল, সে কাগজ কি আছে। বেটা ভণ্ড সন্ন্যাসী কাগজে কতকগুলা হিজিবিজি কাটিয়া আমাকে ফাঁকি দিয়া গেল—আমি সে পুড়াইয়া ফেলিয়াছি।”

 শংকর চুপ করিয়া রহিল। হঠাৎ একদিন শংকরকে ঘরে দেখিতে পাওয়া গেল না। তাহার পর হইতে সে নিরুদ্দেশ।

 হরিহরের অন্য সমস্ত কাজকর্ম নষ্ট হইল—গুপ্ত ঐশ্বর্যের ধ্যান একমুহূর্ত সে ছাড়িতে পারিল না।

 মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে সে তাহার বড়াে ছেলে শ্যামাপদকে এই সন্ন্যাসীদত্ত কাগজখানি দিয়া গেল।

 এই কাগজ পাইয়া শ্যামাপদ চাকরি ছাড়িয়া দিল। জয়কালীর পূজায় আর একান্তমনে এই লিখনপাঠের চর্চায় তাহার জীবনটা যে কোন্ দিক দিয়া কাটিয়া গেল তাহা বুঝিতে পারিল না।

 মৃত্যুঞ্জয় শ্যামাপদর বড়াে ছেলে। পিতার মৃত্যুর পরে সে এই সন্ন্যাসীদত্ত গুপ্তলিখনের অধিকারী হইয়াছে। তাহার অবস্থা উত্তরােত্তর যতই হীন হইয়া আসিতে লাগিল, ততই অধিকতর আগ্রহের সহিত ঐ কাগজখানির প্রতি তাহার সমস্ত চিত্ত নিবিষ্ট হইল। এমন সময় গত অমাবস্যারাত্রে পূজার পর লিখনখানি আর দেখিতে পাইল না—সন্ন্যাসীও কোথায় অন্তর্ধান করিল।

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “এই সন্ন্যাসীকে ছাড়া হইবে না। সমস্ত সন্ধান ইহার কাছ হইতেই মিলিবে।”

 এই বলিয়া সে ঘর ছাড়িয়া সন্ন্যাসীকে খুঁজিতে বাহির হইল। এক বৎসর পথে পথে কাটিয়া গেল।

গ্রামের নাম ধারাগােল। সেখানে মৃত্যুঞ্জয় মুদির দোকানে বসিয়া তামাক খাইতেছিল আর অন্যমনস্ক হইয়া নানা কথা ভাবিতেছিল। কিছু দূরে মাঠের ধার দিয়া একজন