পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গুপ্তধন
৫৫৭

ধরিয়া মৃত্যুঞ্জয় ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। বহুক্ষণ ধরিয়া অনেক আঁকাবাঁকা পথ দিয়া অনেক ঘুরিয়া-ফিরিয়া এক জায়গায় আসিয়া সন্ন্যাসী কহিলেন, “দাঁড়াও।”

 মত্যুঞ্জয় দাঁড়াইল। তাহার পরে একটা মরিচাপড়া লােহার দ্বার খােলার উৎকট শব্দ শােনা গেল। সন্ন্যাসী মৃত্যুঞ্জয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “এসাে।”

 মৃত্যুঞ্জয় অগ্রসর হইয়া যেন একটা ঘরে প্রবেশ করিল। তখন আবার চকমকি ঠোকার শব্দ শােনা গেল। কিছুক্ষণ পরে যখন মশাল জ্বলিয়া উঠিল তখন এ কী আশ্চর্য দৃশ্য! চারি দিকে দেয়ালের গায়ে মােটা মােটা সােনার পাত ভূগর্ভরুদ্ধ কঠিন সূর্যালােকপুঞ্জের মতাে স্তরে স্তরে সজ্জিত। মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ দুটো জ্বলিতে লাগিল। সে পাগলের মতাে বলিয়া উঠিল, “এ সােনা আমার—এ আমি কোনােমতেই ফেলিয়া যাইতে পারিব না।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “আচ্ছা, ফেলিয়া যাইয়াে না; এই মশাল রহিল—আর এই ছাতু চিঁড়া আর বড়ো এক-ঘটি জল রাখিয়া গেলাম।”

 দেখিতে দেখিতে সন্ন্যাসী বাহির হইয়া আসিলেন, আর এই স্বর্ণভাণ্ডারের লৌহদ্বারে কপাট পড়িল।

 মত্যুঞ্জয় বারবার করিয়া এই স্বর্ণপঞ্জ স্পর্শ করিয়া ঘরময় ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। হােটো ছােটো স্বর্ণখণ্ড টানিয়া মেজের উপরে ফেলিতে লাগিল, কোলের উপর তুলিতে লাগিল, একটার উপরে আর-একটা আঘাত করিয়া শব্দ করিতে লাগিল, সর্বাঙ্গের উপর বুলাইয়া তাহার স্পর্শ লইতে লাগিল। অবশেষে শ্রান্ত হইয়া সােনার পাত বিছাইয়া তাহার উপর শয়ন করিয়া ঘুমাইয়া পড়িল।

 জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, চারি দিকে সােনা ঝক্‌ঝক করিতেছে। সােনা ছাড়া আর-কিছুই নাই। মত্যুঞ্জয় ভাবিতে লাগিল, পথিবীর উপরে হয়তাে এতক্ষণে প্রভাত হইয়াছে, সমস্ত জীবজন্তু আনন্দে জাগিয়া উঠিয়াছে।—তাহাদের বাড়িতে পুকুরের ধারের বাগান হইতে প্রভাতে যে একটি সিদ্ধ গন্ধ উঠিত তাহাই কল্পনায় তাহার নাসিকায় যেন প্রবেশ করিতে লাগিল। সে যেন স্পষ্ট চোখে দেখিতে পাইল, পাতিহাঁসগুলি দুলিতে দুলিতে কলরব করিতে করিতে সকালবেলায় পুকুরের জলের মধ্যে আসিয়া পড়িতেছে, আর বাড়ির ঝি বামা কোমরে কাপড় জড়াইয়া ঊর্ধ্বোত্থিত দক্ষিণ হস্তের উপর একরাশি পিতল-কাঁসার থালা বাটি লইয়া ঘাটে আনিয়া উপস্থিত করিতেছে।

 মৃত্যুঞ্জয় দ্বারে আঘাত করিয়া ডাকিতে লাগিল, “ওগাে সন্ন্যাসীঠাকুর, আছ কি।”

 দ্বার খুলিয়া গেল। সন্ন্যাসী কহিলেন, “কী চাও।”

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “আমি বাহিরে যাইতে চাই—কিন্তু সঙ্গে এই সােনার দুটো-একটা পাতও কি লইয়া যাইতে পারিব না।”

 সন্ন্যাসী তাহার কোনাে উত্তর না দিয়া নুতন মশাল জ্বালাইলেন—পূর্ণ কমণ্ডলু একটি রাখিলেন, আর উত্তরীয় হইতে কয়েক মুষ্টি চিঁড়া মেজের উপর রাখিয়া বাহির হইয়া গেলেন। দ্বার বন্ধ হইয়া গেল।

 মত্যুঞ্জয় পাৎলা একটা সােনার পাত লইয়া তাহা দোমড়াইয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া ফেলিল। সেই খণ্ড সােনাগুলােকে লইয়া ঘরের চারি দিকে লৌষ্ট্রখণ্ডের মতাে ছড়াইতে লাগিল। কখনাে বা দাঁত দিয়া দংশন করিয়া সােনার পাতের উপর দাগ