যে, সেখানে কালীপদর ভাগী কেহ ছিল না। সুতরাং, যদিচ সেখানে বাতাস চলিত
না তবু পড়াশুনা অবাধে চলিত। যেমনই হউক, সুবিধা-অসুবিধা বিচার করিবার
অবস্থা কালীপদর নহে।
এ মেসে যাহারা ভাড়া দিয়া বাস করে, বিশেষত যাহারা দ্বিতীয় তলের
উচ্চলোকে থাকে, তাহাদের সঙ্গে কালীপদর কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু, সম্পর্ক না
থাকিলেও সংঘাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায় না। উচ্চের বজ্রাঘাত নিম্নের পক্ষে
কতদূর প্রাণান্তিক, কালীপদর তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না।
এই মেসের উচ্চলোকে ইন্দ্রের সিংহাসন যাহার, তাহার পরিচয় আবশ্যক।
তাহার নাম শৈলেন্দ্র। সে বড়োমানুষের ছেলে; কলেজে পড়িবার সময় মেসে থাকা
তাহার পক্ষে অনাবশ্যক—তবু সে মেসে থাকিতেই ভালোবাসিত।
তাহাদের বৃৃহৎ পরিবার হইতে কয়েকজন স্ত্রী ও পুরুষ-জাতীয় আত্মীয়কে
আনাইয়া কলিকাতায় একটি বাসা ভাড়া করিয়া থাকিবার জন্য বাড়ি হইতে অনুরোধ
আসিয়াছিল—সে তাহাতে কোনোমতেই রাজি হয় নাই।
সে কারণ দেখাইয়াছিল যে, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে থাকিলে তাহার পড়াশুনা
কিছুই হইবে না। কিন্তু, আসল কারণটা তাহা নহে। শৈলেন্দ্র লোকজনের সঙ্গ
খুবই ভালোবাসে; কিন্তু আত্মীয়দের মুশকিল এই যে, কেবলমাত্র তাহাদের সঙ্গটি
লইয়া খালাস পাওয়া যায় না, তাহাদের নানা দায় স্বীকার করিতে হয়—কাহারও
সম্বন্ধে এটা করিতে নাই, কাহারও সম্বন্ধে ওটা না করিলে অত্যন্ত নিন্দার কথা।
এইজন্য শৈলেন্দ্রের পক্ষে সকলের চেয়ে সুবিধার জায়গা মেস। সেখানে লোক যথেষ্ট
আছে, অথচ তাহার উপর তাহাদের কোনো ভার নাই। তাহারা আসে যায়, হাসে,
কথা কয়; তাহারা নদীর জলের মতো, কেবলই বহিয়া চলিয়া যায় অথচ কোথাও
লেশমাত্র ছিদ্র রাখে না।
শৈলেন্দ্রের ধারণা ছিল, সে লোক ভালো, যাহাকে বলে সহৃদয়। সকলেই জানেন, এই ধারণাটির মস্ত সুবিধা এই যে, নিজের কাছে ইহাকে বজায় রাখিবার জন্য
ভালো-লোক হইবার কোনো দরকার করে না। অহংকার জিনিসটা হাতি-ঘোড়ার মতো
নয়; তাহাকে নিতান্তই অল্প খরচে ও বিনা খোরাকে বেশ মোটা করিয়া রাখা যায়।
কিন্তু, শৈলেন্দ্রের ব্যয় করিবার সামর্থ্য ও প্রবৃত্তি ছিল—এইজন্য আপনার
অহংকারটাকে সে সম্পূর্ণ বিনা খরচে চরিয়া খাইতে দিত না; দামি খোরাক দিয়া
তাহাকে সুন্দর সুসজ্জিত করিয়া রাখিয়াছিল।
বস্তুত শৈলেন্দ্রের মনে দয়া যথেষ্ট ছিল। লোকের দুঃখ দূর করিতে সে সত্যই
ভালোবাসিত। কিন্তু, এত ভালোবাসিত যে, যদি কেহ দুঃখ দূর করিবার জন্য তাহার
শরণাপন্ন না হইত তাহাকে সে বিধিমতে দুঃখ না দিয়া ছাড়িত না। তাহার দয়া
যখন নির্দয় হইয়া উঠিত তখন বড়ো ভীষণ আকার ধারণ করিত।
মেসের লোকদিগকে থিয়েটার-দেখানো, পাঁঠা-খাওয়ানো, টাকা ধার দিয়া সে
কথাটাকে সর্বদা মনে করিয়া না রাখা—তাহার দ্বারা প্রায়ই ঘটিত। নবপরিণীত
মুগ্ধ যুবক পূজার ছুটিতে বাড়ি যাইবার সময় কলিকাতার বাসাখরচ, সমস্ত শোধ
করিয়া যখন নিঃস্ব হইয়া পড়িত তখন বধুর মনোহরণের উপযোগী শৌখিন সাবান
এবং এসেন্স্, আর তারই সঙ্গে এক-আধখানি হালের আমদানি বিলাতি ছিটের
পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৮৭
পরিভ্রমণে ঝাঁপ দিন
অনুসন্ধানে ঝাঁপ দিন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৯৭
রাসমণির ছেলে
