পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৩৮২
গল্পগুচ্ছ

একটি উজ্জ্বল রক্তচিহ্ন আঁকিয়া দিয়াছে, সেই মায়াগণ্ডির মোহমন্ত্রে কবিতাটি আজ তাহারই, এবং সেই সঙ্গে আমারও। আমি পুলকোচ্ছ্বসিত চিত্তকে সম্বরণ করিয়া সহজ সুরে কহিলাম, “কী পড়িতেছেন।” পালভরা নৌকা যেন হঠাৎ চড়ায় ঠেকিয়া গেল। কিরণ চমকিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি বইখানা বন্ধ করিয়া একেবারে আঁচলের মধ্যে ঢাকিয়া ফেলিল। আমি হাসিয়া কহিলাম, “বইখানা একবার দেখিতে পারি? কিরণকে কী যেন বাজিল, সে আগ্রহসহকারে বলিয়া উঠিল, “না না, ও বই থাক্।”

 আমি কিয়দ্‌দূরে একটা ধাপ নীচে বসিয়া ইংরাজি কাব্যসাহিত্যের কথা উত্থাপন করিলাম, এমন করিয়া কথা তুলিলাম যাহাতে কিরণেরও সাহিত্যশিক্ষা হয় এবং আমারও মনের কথা ইংরাজ কবির জবানিতে ব্যক্ত হইয়া উঠে। খররৌদ্রতাপে সুগভীর নিস্তদ্ধতার মধ্যে জলের স্থলের ছোটো ছোেটা কলশব্দগুলি জননীর ঘুমপাড়ানি-গানের মতো অতিশয় মৃদু এবং সকরুণ হইয়া আসিল।

 কিরণ যেন অধীর হইয়া উঠিল; কহিল, “বাবা একা বসিয়া আছেন, অনন্ত আকাশ সম্বন্ধে আপনাদের সে তর্কটা শেষ করিবেন না?” আমি মনে মনে ভাবিলাম, ‘অনন্ত আকাশ তো চিরকাল থাকিবে এবং তাহার সম্বন্ধে তর্কও তো কোনোকালে শেষ হইবে না, কিন্তু জীবন স্বল্প এবং শুভ অবসর দুর্লভ ও ক্ষণস্থায়ী।’ কিরণের কথার উত্তর না দিয়া কহিলাম, “আমার কতকগুলি কবিতা আছে, আপনাকে শুনাইব।” কিরণ কহিল, “কাল শুনিব।” বলিয়া একেবারে উঠিয়া ঘরের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, “বাবা, মহীন্দ্রবাবু, আসিয়াছেন।” ভবনাথবাবু নিদ্রাভঙ্গে বালকের ন্যায় তাঁহার সরল নেত্রদ্বয় উন্মীলন করিয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। আমার বক্ষে যেন ধক্ করিয়া একটা মস্ত ঘা লাগিল। ভবনাথবাবুর ঘরে গিয়া অনন্ত আকাশ সম্বন্ধে তর্ক করিতে লাগিলাম। কিরণ বই হাতে লইয়া দোতলায় বোধ হয় তাহার নির্জন শয়নকক্ষে নির্বিঘ্নে পড়িতে গেল।


পরদিন সকালের ডাকে লাল পেন্সিলের দাগ-দেওয়া একখানা স্টেট্‌স্‌ম্যান কাগজ পাওয়া গেল, তাহাতে বি. এ. পরীক্ষার ফল বাহির হইয়াছে। প্রথমেই প্রথম-ডিবিশান-কোঠায় কিরণবালা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়া একটা নাম চোখে পড়িল। আমার নিজের নাম প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় কোনো বিভাগেই নাই।


পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইবার বেদনার সঙ্গে সঙ্গে বজ্রাগ্নির ন্যায় একটা সন্দেহ বাজিতে লাগিল যে, কিরণবালা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো আমাদেরই কিরণবালা। সে যে কালেজে পড়িয়াছে বা পরীক্ষা দিয়াছে, এ কথা যদিও আমাকে বলে নাই তথাপি সন্দেহ ক্রমেই প্রবল হইতে লাগিল। কারণ, ভাবিয়া দেখিলাম, বৃদ্ধ পিতা এবং তাঁহার কন্যাটি নিজেদের সম্বন্ধে কোনো কথাই কখনও আলাপ করেন নাই, এবং আমিও নিজের আখ্যান বলিতে এবং নিজের বিদ্যা প্রচার করতে সর্বদাই এমন নিযুক্ত ছিলাম যে, তাঁহাদের কথা ভালো করিয়া জিজ্ঞাসাও করি নাই।

 জর্মানপণ্ডিত-রচিত আমার নূতন-পড়া দর্শনের ইতিহাস সম্বন্ধীয় তর্কগুলি আমার মনে পড়িতে লাগিল, এবং মনে পড়িল, আমি একদিন কিরণকে বলিয়ছিলাম, আপনাকে যদি আমি কিছুদিন গুটিকতক বই পড়াইবার সুযোেগ পাই তাহা হইলে