পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৪৩৮
গল্পগুচ্ছ

করিলেন, অকস্মাৎ রসভঙ্গ হইয়া লােকটা সেইখানে ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল। কাতি পুনরায় কামরায় আসিয়া বন্দক সাফ করিতে লাগিলেন।

 সেইদিন বেলা প্রহর-তিনেকের সময় গ্রামপথের ঘনচ্ছায়ার মধ্য দিয়া শিকারীর দল শস্যক্ষেত্রের দিকে চলিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে একজন বন্দুকের আওয়াজ করিয়া দিল। কিছু দূরে বাঁশঝাড়ের উপর হইতে কী-একটা পাখি আহত হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ভিতরের দিকে পড়িয়া গেল। | কৌতহলী কান্তিচন্দ্র পাখির সন্ধানে ঝােপঝাড় ভেদ করিয়া ভিতরে গিয়া দেখিলেন, একটি সচ্ছল গহস্পঘর, প্রাঙ্গণে সারি সারি ধানের গােলা। পরিচ্ছন্ন বহৎ গােয়ালঘরে কুলগাছতলায় বসিয়া সকালবেলাকার সেই মেয়েটি একটি আহত দুঘ, বুকের কাছে তুলিয়া উচ্ছসিত হইয়া কাঁদিতেছে এবং গামলার জলে অঞ্চল ভিজাইয়া পাখির চঞ্চপটের মধ্যে জল নিংড়াইয়া দিতেছে। পােষ বিড়ালটা তাহার কোলের উপরই পা তুলিয়া উমখে ঘুঘটির প্রতি উৎসুক দৃষ্টিপাত করিতেছে; বালিকা মধ্যে মধ্যে তাহার নাসিকাগ্রভাগে তর্জনী-আঘাত করিয়া লৰ জন্তুর অতিরিক্ত আগ্রহ দমন করিয়া দিতেছে।

 পল্লির নিন্তব্ধ মধ্যাহ্নে একটি গৃহস্থপ্রাঙ্গণের সচ্ছল শান্তির মধ্যে এই করণছবি এক মহতেই কান্তিচন্দ্রের হদয়ের মধ্যে আঁকা হইয়া গেল। বিরলপল্লব গাছটির ছায়া ও রৌদ্র বালিকার ক্রোড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে; অদরে আহারপরিতৃপ্ত পরিপুষ্ট গাভী আলস্যে মাটিতে বসিয়া শন্স ও পচ্ছ -আন্দোলনে পিঠের মাছি তাড়াইতেছে; মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড়ে ফিস ফিস কথার মতাে নতন উত্তরবাতাসে খস খস শব্দ উঠিতেছে। সেদিন প্রভাতে নদীতীরে বনের মধ্যে যাহাকে বনশ্রীর মতাে দেখিতে হইয়াছিল, আজ মধ্যাহ্নে নিস্তব্ধ পােঠপ্রাঙ্গণচ্ছায়ায় তাহাকে নেইবিগলিত গহলক্ষীটির মতাে দেখিতে হইল।

 কান্তিচন্দ্র বন্দুকহতে হঠাৎ এই ব্যথিত বালিকার সম্মুখে আসিয়া অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। মনে হইল, ‘যেন বমালস চোর ধরা পড়িলাম। পাখিটি যে আমার গুলিতে আহত হয় নাই কোনােপ্রকারে এই কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছা হইল। কেমন করিয়া কথাটা পাড়িবেন ভাবিতেছেন, এমন সময়ে কুটির হইতে কে ডাকিল, “সুধা।” বালিকা যেন চমকিত হইয়া উঠিল। আবার ডাক পড়িল, “সুধা।” তখন সে-তাড়াতাড়ি পাখিটি সইয়া কুটিমুখে চলিয়া গেল। কাতিচন্দ ভাবিলেন, নামটি উপতে বটে। সাধা!

 কান্তি তখন দলের লােকের হাতে বন্দক রাখিয়া সদর পথ দিয়া সেই কুটিরের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, একটি প্রৌঢ়বয়স্ক মণ্ডিতমখ শান্তমতি ব্ৰাহরণ দাওয়ায় বসিয়া হরিভক্তিৰিলাস পাঠ করিতেছেন। ভক্তিমণ্ডিত তাঁহার মুখের গভীর ক্ষিপ্ত প্রশান্ত ভাবের সহিত কান্তিচন্দ্র সেই বালিকার দয়া মনে সাদশ অনুভব করিলেন। | কাতি তাঁহাকে নমস্কার করিয়া কহিলেন, “শ পাইয়াছে ঠাকুর, এক ঘটি জল পাইতে পারি কি।”

 রাহুশি তাড়াতড়ি তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বাইলেন এবং ভিতর হইতে পিতলের রেকাবিতে কয়েকটি বাতাসা ও কাসার ঘটিতে জল লইয়া স্বহস্তে অতিথির