পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Տ ՕՀ গল্পগুচ্ছ বাল্যসাদশ্য উভয়ের চক্ষে ক্রমশই পরিসফট হইয়া উঠিল। যোগমায়া কহিল, "ওমা, আমার কী ভাগ্য। তোমার যে দশন পাইব এমন তো আমার মনেই ছিল না। কিন্তু, ভাই, তুমি কী করিয়া আসিলে। তোমার বশরেবাড়ির লোকেরা যে তোমাকে ছাড়িয়া দিল !" কাদম্বিনী চুপ করিয়া রহিল; অবশেষে কহিল, "ভাই, শ্বশুরবাড়ির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না। আমাকে দাসীর মতো বাড়ির এক প্রান্তে পথান দিয়ো, আমি তোমাদের কাজ করিয়া দিব।” যোগমায়া কহিল, "ওমা, সে কী কথা । দাসীর মতো থাকিবে কেন । তুমি আমার সই, তুমি আমার”— ইত্যাদি। এমন সময় শ্রীপতি ঘরে প্রবেশ করিল। কাদম্বিনী খানিকক্ষণ তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয় গেল— মাথায় কাপড় দেওয়া, বা কোনোরপে সংকোচ বা সম্প্রমের লক্ষণ দেখা গেল না। পাছে তাহার সইয়ের বিরুদ্ধে শ্ৰীপতি কিছ মনে করে, এজন্য বাস্ত হইয়া যোগমায়া নানারপে তাহাকে বঝাইতে আরম্ভ কবিল। কিন্তু এতই অল্প বঝোইতে হইল এবং শ্রীপতি এত সহজে যোগমায়ার সমস্ত প্রস্তাবে অনুমোদন করিল যে, যোগমায়া মনে-মনে বিশেষ সন্তুষ্ট হইল না। কাদম্বিনী সইয়ের বাড়িতে আসিল, কিন্তু সইফের সঙ্গে মিশিতে পারিল না-- মাঝে মৃত্যুর ব্যবধান। আত্মসম্বন্ধে সবাদা একটা সন্দেহ এবং চেতনা থাকিলে পরের সঙ্গে মেলা যায় না। কাদম্বিনী যোগমায়ার মুখের দিকে চায় এবং কী যেন ভাবে— মনে করে, স্বামী এবং ঘরকন্না লইয়া ও যেন বহু দরে আর-এক জগতে আছে। স্নেহ-মমতা এবং সমস্ত কতব্য লইযা ও যেন পৃথিবীব লোক, আর আমি যেন শনা ছায়া। ও যেন অস্তিত্বের দেশে, আর আমি যেন অনন্তের মধ্যে । যোগমায়ার ও কেমন কেমন লাগিল, কিছুই বুঝিতে পাবিল না। সন্ত্রীলোক রহস্য সহ্য করিতে পারে না—কারণ অনিশ্চিতকে লইয়া কবিত্ব করা যায়, বীরত্ব করা যায়, পাণ্ডিত্য করা যায়, কিন্তু ঘরকন্না করা যায় না। এইজন্য সত্ৰীলোক যেটা বুঝিতে পারে না, হয় সেটার অস্তিত্ব বিলোপ করিযা তাহাব সহিত কোনো সম্পক বাখে না, নয় তাহাকে স্বহস্তে নতেন মতি দিযা নিজের ব্যবহারযোগ্য একটি সামগ্রী গড়িয়া তোলে— যদি দইয়ের কোনোটাই না পারে তবে তাহার উপর ভারি রাগ করিতে থাকে । কাদম্বিনী যতই দুবোধ হইয়া উঠিল যোগমাযা তাহার উপর ততই রাগ করিতে লাগিল; ভাবিল, এ কী উপদ্রব কন্ধের উপর চাপিল । আবার আর-এক বিপদ। কাদবিনীর আপনাকে আপনি ভয় কবে । সে নিজের কাছ হইতে নিজে কিছুতেই পলাইতে পারে না। যাহাদের ভূতের ভয় আছে তাহারা আপনার পশ্চাদদিককে ভয় করে— যেখানে দটি রাখিতে পারে না সেইখানেই ভয় । কিন্তু, কাদম্বিনীর আপনার মধ্যেই সবাপেক্ষা বেশি ভয়, বাহিরে তার ভয় নাই । এইজন্য বিজন বিপ্রহরে সে একা ঘরে এক-একদিন চীৎকার করিয়া উঠিত, এবং সন্ধ্যাবেলায় দীপালোকে আপনার ছায়া দেখিলে তাহার গা ছমছম করিতে থাকিত। তাহার এই ভয় দেখিয়া বাড়িসন্ধ লোকের মনে কেমন একটা ভয় জমিয়া গেল ।