পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২২ গল্পগুচ্ছ অপরাজিতাও মঞ্জরীকে লইয়া মাঝে মাঝে উপহাস করিয়া থাকিবেন। মঞ্জরী তাহাতে অসন্তুষ্ট হইত না। এমনি করিয়া সত্যে মিথ্যায় মিশাইয়া মানুষের জীবন একরকম করিয়া কাটিয়া যায়— খানিকটা বিধাতা গড়েন, খানিকটা আপনি গড়ে, খানিকটা পাঁচজনে গড়িয়া দেয়। জীবনটা একটা পাঁচমিশালি রকমের জোড়াতাড়া— প্রকৃত এবং অপ্রকৃত, কাল্পনিক এবং বাসতবিক । কেবল কবি যে গানগুলি গাহিতেন তাহাই সত্য এবং সম্পণে। গানের বিষয় সেই রাধা এবং কৃষ্ণ— সেই চিরন্তন নর এবং চিরন্তন নারী, সেই অনাদি দুঃখ এবং অনন্ত সুখ। সেই গানেই তাঁহার যথার্থ নিজের কথা ছিল এবং সেই গানের যাথার্থ্য অমরাপরের রাজা হইতে দীনদঃখী প্রজা পর্যন্ত সকলেই আপনার হৃদযে হািদয়ে পরীক্ষা করিয়াছিল। তাঁহার গান সকলেরই মখে। জ্যোৎসনা উঠিলেই, একট দক্ষিণা বাতাসের আভাস দিলেই অমনি দেশের চতুদিকে কত কানন, কত পথ, কত নৌকা, কত বাতায়ন, কত প্রাঙ্গণ হইতে তাঁহার রচিত গান উচ্ছসিত হইয়া উঠিত— তাঁহার খ্যাতির আর সীমা ছিল না। এইভাবে অনেক দিন কাটিয়া গেল। কবি কবিতা লিখিতেন, রাজা শুনিতেন, রাজসভার লোক বাহবা দিত, মঞ্জরী ঘাটে আসিত— এবং অন্তঃপুরের বাতায়ন হইতে কখনো কখনো একটা ছায়া পড়িত, কখনো কখনো একটা নপরে শনা যাইত। এমন সময়ে দাক্ষিণাত্য হইতে এক দিগ বিজয়ী কবি শাদ লবিক্ৰীড়িত ছন্দে রাজার স্তবগান করিয়া রাজসভায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি সবদেশ হইতে বাহির হইয়া পথিমধ্যে সমস্ত রাজকবিদিগকে পরাস্ত করিয়া অবশেষে আমরাপরে আসিয়া উপসিথত হইয়াছেন। রাজা পরম সমাদরের সহিত কহিলেন, “এহি এহি ।” কবি পণ্ডেরীক দম্ভভরে কহিলেন, “যন্ধং দেহি ।” রাজার মান রাখিতে হইবে, যন্ধ দিতে হইবে ; কিন্তু, কাব্যযন্ধ যে কিরাপ হইতে পারে শেখরের সে সম্বন্ধে ভালোরাপ ধারণা ছিল না। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত ও শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। রাত্রে নিদ্রা হইল না। যশস্বী পণ্ডেরীকের দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ, সতীক্ষ বক্স নাসা এবং দপোন্ধত উন্নত মস্তক দিগ বিদিকে অঙ্কিত দেখিতে লাগিলেন। প্রাতঃকালে কল্পিতহাদয় কবি রণক্ষেত্রে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। প্রত্যুষ হইতে সভাতল লোকে পরিপণ হইয়া গেছে, কলরবের সীমা নাই ; নগরে আর-সমস্ত কাজকম একেবারে বন্ধ । কবি শেখর বহকেন্টে মুখে সহাস্য প্রফুল্লতার আয়োজন করিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী কবি পণ্ডেরীককে নমস্কার করিলেন : পণ্ডেরীক প্রচণ্ড অবহেলাভরে নিতান্ত ইঙ্গিতমাত্রে নমস্কার ফিরাইয়া দিলেন এবং নিজের অনবতী ভক্তবন্দের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। শেখর একবার অন্তঃপরে জালায়নের দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন—বঝিতে