পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কাবলিওয়ালা SళిS রহমত একটা অনাবশ্যক চন্দ্রবিন্দ যোগ করিয়া হাসিতে হাসিতে উত্তর করিত, "হাতি।” অর্থাৎ, তাহার ঝুলির ভিতরে যে একটা হস্তী আছে এইটেই তাহার পরিহাসের সক্ষম মম । খব যে বেশি সক্ষম তাহা বলা যায় না, তথাপি এই পরিহাসে উভয়েই বেশ একটা কৌতুক অনুভব করিত—এবং শরৎকালের প্রভাতে একটি বয়স্ক এবং একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশর সরল হাস্য দেখিয়া আমারও বেশ লাগিত। উহাদের মধ্যে আরো-একটা কথা প্রচলিত ছিল। রহমত মিনিকে বলিত, “খেখিী, তোমি সসরবাড়ি কখন যাবে না!” বাঙালির ঘরের মেয়ে আজন্মকাল শ্বশুরবাড়ি’ শব্দটার সহিত পরিচিত, কিন্তু আমরা কিছু একেলে ধরনের লোক হওয়াতে শিশু মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে সজ্ঞান করিয়া তোলা হয় নাই। এইজন্য রহমতের অনুরোধটা সে পরিস্কার বকিতে পারিত ন, অথচ কথাটার একটা-কোনো জবাব না দিয়া চুপ করিয়া থাকা নিতান্ত তাহার স্বভাববিরধে—সে উলটিয়া জিজ্ঞাসা করিত, “তুমি বশরেবাড়ি যাবে ?” রহমত কাল্পনিক শবশরের প্রতি প্রকাণ্ড মোটা মাটি আস্ফালন করিয়া বলিত, “হামি সসরকে মারবে ।” শনিয়া মিনি শ্বশর-নামক কোনো-এক অপরিচিত জীবের দরবস্থা কল্পনা করিয়া অত্যন্ত হাসিত । এখন শত্র শরৎকাল। প্রাচীনকালে এই সময়েই রাজারা দিগবিজয়ে বাহির হইতেন। আমি কলিকাতা ছাড়িয়া কখনো কোথাও যাই নাই, কিন্তু সেইজন্যই আমার মনটা পৃথিবীময় ঘরিয়া বেড়ায় । আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পথিবীর জন্য আমার সব দা মন কেমন করে। একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছটিয়া যায়, তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী-পবত-অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরের দশ্য মনে উদয় হয় এবং একটা উল্লাসপণ স্বাধীন জীবনযাত্রার কথা কল্পনায় জাগিয়া উঠে । এ দিকে আবার আমি এমনি উদ্ভিজ্জপ্রকৃতি যে, আমার কোণটুকু ছাড়িয়া একবার বাহির হইতে গেলে মাথায় বজ্রাঘাত হয় । এইজন্য সকালবেলায় আমার ছোটো ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া এই কাবলির সঙ্গো গল্প করিয়া আমার অনেকটা ভ্রমণের কাজ হইত। দুই ধারে বন্ধর দাগম দগধ রক্তবশ উচ্চ গিরিশ্রেণী, মধ্যে সংকীর্ণ মর পথ, বোঝাই-করা উস্ট্রের শ্রেণী চলিয়াছে; পাগড়ি-পরা বণিক ও পথিকেরা কেহবা উটের পরে, কেহ-বা পদব্রজে, কাহারও হাতে বশী, কাহারও হাতে সেকেলে চকমকি-ঠোকা বন্দকে—কাবলি মেঘমন্দ্রস্বরে ভাঙা বাংলায় সবদেশের গল্প করিত আর এই ছবি আমার চোখের সম্মখে দিয়া চলিয়া যাইত। মিনির মা অত্যন্ত শঙ্কিত স্বভাবের লোক। রাস্তায় একটা শব্দ শুনিলেই তাঁহার মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত মাতাল আমাদের বাড়িটাই বিশেষ লক্ষ্য করিয়া ছটিয়া আসিতেছে। এই পথিবীটা যে সবাই চোর ডাকাত মাতাল সাপ বাঘ ম্যালেরিয়া শয়াপোকা আরসোলা এবং গোরার বারা পরিপণ", এতদিন খেবে বেশি দিন নহে) পথিবীতে বাস করিয়াও সে বিভীষিকা তাঁহার মন হইতে রে হইয়া যায় নাই।