পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Տ8Հ গল্পগুচ্ছ সভা মেয়েটির নাম যখন সভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বোবা হহবে। তাহার দটি বড়ো বোনকে সকেশিনী ও সহাসিনী নাম দেওয়া হইয়াছিল, তাই মিলের অনুরোধে তাহার বাপ ছোটো মেয়েটির নাম সভাষিণী রাখে। এখন সকলে তাহাকে সংক্ষেপে সভা বলে। দস্তুরমত অনুসন্ধান ও অথব্যয়ে বড়ো দটি মেয়ের বিবাহ হইয়া গেছে, এখন ছোটোটি পিতামাতার নীরব হন্দয়ভারের মতো বিরাজ করিতেছে। যে কথা কয় না সে যে অনুভব করে ইহা সকলের মনে হয় না, এইজন্য তাহার সাক্ষাতেই সকলে তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করিত। সে যে বিধাতার অভিশাপস্বরপে তাহার পিতৃগহে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে এ কথা সে শিশুকাল হইতে বঝিয়া লইয়াছিল। তাহার ফল এই হইয়াছিল, সাধারণের দষ্টিপথ হইতে সে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিতে সবাদাই চেষ্টা করিত। মনে করিত, আমাকে সবাই ভুলিলে বাঁচ। কিন্তু, বেদনা কি কেহ কখনো ভোলে। পিতামাতার মনে সে সবদাই জাগরকে ছিল। বিশেষত, তাহার মা তাহাকে নিজের একটা ক্রটিসবরপে দেখিতেন; কেননা, মাতা পত্র অপেক্ষা কন্যাকে নিজের অংশরীপে দেখেন– কন্যার কোনো অসম্পর্ণেতা দেখিলে সেটা যেন বিশেষরপে নিজের লন্জার কারণ বলিয়া মনে করেন। বরঞ্চ, কন্যার পিতা বাণীকণ্ঠ সভাকে তাঁহার অন্য মেয়েদের অপেক্ষা যেন একটা বেশি ভালোবাসতেন; কিন্তু মাতা তাহাকে নিজের গর্ভের কলক জ্ঞান করিয়া তাহার প্রতি বড়ো বিরক্ত ছিলেন। সভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সদেীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট বড়ো বড়ো দটি কালো চোখ ছিল— এবং তাহার ওঠাধর ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতো কপিরা উঠিত। কথায় আমরা যে ভাব প্রকাশ করি সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তজমা করার মতো ; সকল সময়ে ঠিক হয় না, ক্ষমতাঅভাবে অনেক সময়ে ভুলও হয়। কিন্তু, কালো চোখকে কিছু তজমা করিতে হয় না— মন আপনি তাহার উপরে ছায়া ফেলে ; ভাব আপনি তাহার উপরে কখনো প্রসারিত কখনো মনুদিত হয় ; কখনো উক্তরলভাবে জনলিয়া উঠে, কখনো লানভাবে নিবিয়া আসে, কখনো অস্তমান চন্দ্রের মতো অনিমেষভাবে চাহিয়া থাকে, কখনো দ্রুত চঞ্চল বিদ্যুতের মতো দিগবিদিকে ঠিকরিয়া উঠে। মাখের ভাব বৈ আজন্মকাল যাহার অন্য ভাষা নাই তাহার চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলপশ গভীর— অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়াত এবং ছায়ালোকের নিস্তশ্ব রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনয্যের মধ্যে বহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালকবালিকারা তাহাকে একপ্রকার ভয় করিত, তাহার সহিত খেলা করিত না। সে নিজন বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন।