পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সভা ১৪৩ গ্রামের নাম চণ্ডীপার। নদীটি বাংলাদেশের একটি ছোটো নদী, গহস্থঘরের মেয়েটির মতো; বহন্দরে পর্যন্ত তাহার প্রসার নহে; নিরলসা তন্বী নদীটি আপন কল রক্ষা করিয়া কাজ করিয়া যায়; দুই ধারের গ্রামের সকলেরই সঙ্গে তাহার যেন একটা-নাএকটা সম্পক আছে। দই ধারে লোকালয় এবং তরচ্ছোয়াঘন উচ্চ তট; নিম্নতল দিয়া গ্রামলক্ষসী স্রোতস্বিনী আত্মবিস্মত দ্রুত পদক্ষেপে প্রফুল্লহদয়ে আপনার অসংখ্য কল্যাণকাযে চলিয়াছে। বাণীকঠের ঘর নদীর একেবারে উপরেই। তাহার বাঁখারির বেড়া, আটচালা, গোয়ালঘর, ঢেকিশালা, খড়ের পতপে, তেঁতুলতলা, আম কঠাল এবং কলার বাগান নৌকাবাহী-মাত্রেরই দটি আকষণ করে। এই গাহপথ্য সচ্ছলতার মধ্যে বোবা মেয়েটি কাহারও নজরে পড়ে কি না জানি না, কিন্তু কাজকমে যখনি অবসর পায় তখনি সে এই নদীতীরে আসিয়া বসে। প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পরেণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধননি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরর মমর— সমস্ত মিশিয়া চারি দিকের চলাফেরা-আন্দোলন-কক্ষপনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তৰ হৃদয়-উপকলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি ইহাও বোবার ভাষা— বড়ো বড়ো চক্ষপল্লববিশিষ্ট সভার যে ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার; ঝিল্লিরবপণে তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্ৰলোক পৰ্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গী, সংগীত, কদন এবং দীর্ঘনিশ্ববাস । এবং মধ্যাহে যখন মাকিরা জেলেরা খাইতে যাইত, গহন্থেরা ঘামাইত, পাখিরা ডাকিত না, খেয়া-নৌকা বন্ধ থাকিত, সজন জগৎ সমস্ত কাজকমের মাঝখানে সহসা থামিযা গিয়া ভয়ানক বিজনমতি" ধারণ করিত, তখন রন্দ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বোলা প্রকৃতি এবং একটি বোবা মেয়ে মুখামুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত— একজন সবিস্তীর্ণ রৌদ্রে, আর-একজন ক্ষুদ্র তরচ্ছোয়ায়। সভার যে গুটিকতক অন্তরঙ্গ বন্ধরে দল ছিল না তাহা নহে। গোয়ালের দটি গাভী, তাহাদের নাম সবশী ও পাগলি । সে নাম বালিকার মুখে তাহারা কখনো শনে নাই, কিন্তু তাহার পদশব্দ তাহারা চিনিত— তাহার কথাহীন একটা করণে সরে ছিল, তাহার মম' তাহারা ভাষার অপেক্ষা সহজে ব্যকিত। সভা কখন তাহাদের আদর করিতেছে, কখন ভংসনা করিতেছে, কখন মিনতি করিতেছে, তাহা তাহারা মানুষের অপেক্ষ ভালো বকিতে পারিত। সভা গোয়ালে ঢাকিয়া দই বাহরে বারা সবশীর গ্রীবা বেষ্টন করিয়া তাহার কানের কাছে আপনার গণ্ডদেশ ঘষণ করিত এবং পাগলি নিধদটিতে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া তাহার গা চাটিত । বালিকা দিনের মধ্যে নিয়মিত তিনবার করিয়া গোয়ালঘরে যাইত, তাহা ছাড়া অনিয়মিত আগমনও ছিল; গহে যে দিন কোনো কঠিন কথা শানিত সে দিন সে অসময়ে তাহার এই মাক বন্ধদেটির কাছে আসিত—তাহার সহিকতাপরিপন্ণ বিষাদশান্ত দষ্টিপাত হইতে তাহারা কী-একটা