পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৭ O গল্পগুচ্ছ করিয়া একজন নারী হইল দাসী, আর-একজন নারী হইল রানী; তাহাতে দাসীর গৌরব গেল, রানীর সখ রহিল না। কারণ, শৈলবালাও নারীজীবনের যথার্থ সখের বাদ পাইল না। এত অবিশ্রাম আদর পাইল যে, ভালোবাসিবার আর মহত অবসর রহিল না। সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হইয়া, সমুদ্রের মধ্যে আত্মবিসর্জন করিয়া, বোধ করি নদীর একটি মহৎ চরিতার্থতা আছে; কিন্তু সমদ্র যদি জোয়ারের টানে আকৃষ্ট হইয়া ক্ৰমাগতই নদীর উন্মুখীন হইয়া রহে তবে নদী কেবল নিজের মধ্যেই নিজে সফীত হইতে থাকে। সংসার তাহার সমস্ত আদর সোহাগ লইয়া দিবারাত্ৰি শৈলবালার দিকে অগ্রসর হইয়া রহিল, তাহাতে শৈলবালার আত্মাদর অতিশয় উত্তঙ্গে হইয়া উঠিতে লাগিল, সংসারের প্রতি তাহার ভালোবাসা পড়িতে পাইল না। সে জানিল, আমার জন্যই সমস্ত এবং আমি কাহার জন্যও নহি । এ অবস্থায় যথেষ্ট অহংকার আছে, কিন্তু পরিতৃপ্তি কিছুই নাই। চতুর্থ পরিচ্ছেদ এক দিন ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছে। এমনি অন্ধকার করিয়াছে যে, ঘরের মধ্যে কাজকম করা অসাধ্য। বাহিরে ঝাপ ঝুপ করিয়া ব্যষ্টি হইতেছে। কুলগাছের তলায় লতাগালেমর জঙ্গল জলে প্রায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে এবং প্রাচীরের পাশ্ববতী নালা দিয়া ঘোলা জলস্রোত কলকল শব্দে বহিয়া চলিয়াছে। হরসন্দরী আপনার নতন শয়নগহের নিজন অন্ধকারে জানলার কাছে চুপ করিয়া বসিয়া আছে। এমন সময় নিবারণ চোরের মতো ধীরে ধীরে বারের কাছে প্রবেশ করিল, ফিরিয়া যাইবে কি অগ্রসর হইবে ভাবিয়া পাইল না। হরসন্দেরী তাহা লক্ষ্য করিল কিন্তু একটি কথাও কহিল না। তখন নিবারণ হঠাৎ একেবারে তীরের মতো হরসন্দরীর পাবে গিয়া এক নিশবাসে বলিয়া ফেলিল, “গোটাকতক গহনার আবশ্যক হইয়াছে। জান তো অনেকগলো দেনা হইয়া পড়িয়াছে, পাওনাদার বড়োই অপমান করিতেছে- কিছু বন্ধক রাখিতে হইবে— শীঘ্রই ছাড়াইয়া লইতে পারিব।” হরসন্দরী কোনো উত্তর দিল না, নিবারণ চোরের মতো দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে পনেশচ কহিল, “তবে কি আজ হইবে না।” হরসন্দেরী কহিল, “না।” ঘরে প্রবেশ করাও যেমন শক্ত ঘর হইতে অবিলম্বেব বাহির হওয়াও তেমনি কঠিন। নিবারণ একটা এ দিকে ও দিকে চাহিয়া ইতস্তত করিয়া বলিল, “তবে অন্যত্র চেষ্টা দেখি গে যাই।” বলিয়া প্রসথান করিল। ঋণ কোথায় এবং কোথায় গহনা বন্ধক দিতে হইবে হরসন্দেরী তাহা সমস্তই বঝিল। বঝিল, নববধ পবরাত্রে তাহার এই হতবন্ধি পোষা পবেষটিকে অত্যন্ত কংকার দিয়া বলিয়াছিল, “দিদির সিন্দকভরা গহনা, আর আমি বকি একখানি পরিতে পাই না ?” নিবারণ চলিয়া গেলে ধীরে ধীরে উঠিয়া লোহার সিন্দকে খালিয়া একে একে