পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> b 。 গল্পগুচ্ছ এই দই জড়ি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও সবভাবের একটা আশ্চর্য ঐক্য ছিল। দুখিরাম মানুষটা কিছল বহদায়তনের—হাড়গলা খুব চওড়া, নাসিকা খব, দটি চক্ষ এই দশ্যমান সংসারকে যেন ভালো করিয়া বোঝে না, অথচ ইহাকে কোনোরপে প্রশন করিতেও চায় না। এমন নিরীহ অথচ ভীষণ, এমন সবল অথচ নিরপোয় মানুষ অতি দলভ। আর ছিদামকে একখানি চকচকে কালো পাথরে কে যেন বহন যত্নে কুদিয়া গড়িয়া তুলিয়াছে। লেশমাত্র বাহুল্য -বজিত এবং কোথাও যেন কিছ টোল খায় নাই। প্রত্যেক অঙ্গটি বলের সহিত নৈপুণ্যের সহিত মিশিয়া অত্যন্ত সম্পশতা লাভ করিয়াছে। নদীর উচ্চ পাড় হইতে লাফাইয়া পড়কে, লগি দিয়া নৌকা ঠেলক, বশিগাছে চড়িয়া বাছিয়া বাছিয়া কঞ্চি কাটিয়া আনকে, সকল কাজেই তাহার একটি পরিমিত পারিপাট্য, একটি অবলীলাকৃত শোভা প্রকাশ পায়। বড়ো বড়ো কালো চুল তেল দিয়া কপাল হইতে যত্নে অচিড়াইয়া তুলিয়া কাঁধে আনিয়া ফেলিয়াছে— বেশভূষা সাজসজায় বিলক্ষণ একটু যত্ন আছে। অপরাপর গ্রামবধ দিগের সৌন্দয্যের প্রতি যদিও তাহার উদাসীন দটি ছিল না, এবং তাহাদের চক্ষে আপনাকে মনোরম করিয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহার যথেষ্ট ছিল—তব ছিদাম তাহার যাবতী স্ত্রীকে একট বিশেষ ভালোবাসিত । উভয়ে ঝগড়াও হইত, ভাবও হইত, কেহ কাহাকেও পরাস্ত করিতে পারিত না। আর-একটি কারণে উভয়ের মধ্যে বন্ধন কিছু সদঢ় ছিল। ছিদাম মনে করিত, চন্দরা যেরপে চটল চঞ্চল প্রকৃতির সীলোক, তাহাকে যথেষ্ট বিশ্বাস নাই; আর চন্দরা মনে করিত, আমার স্বামীটির চতুদিকেই দটি, তাহাকে কিছু কষাকষি করিযা না বধিলে কোনদিন হাতছাড়া হইতে আটক নাই। উপস্থিত ঘটনা ঘটিবার কিছুকাল পাবে হইতে সতী-পরেষের মধ্যে ভারি একটা গোলযোগ চলিতেছিল। চন্দরা দেখিয়াছিল, তাহার স্বামী কাজের ওক্তর করিয়া মাঝে মাঝে দরে চলিয়া যায়, এমনকি দই-একদিন অতীত করিয়া আসে, অথচ কিছ উপাজন করিয়া আনে না। লক্ষণ মন্দ দেখিয়া সেও কিছু বাড়াবাড়ি দেখাইতে লাগিল। যখন-তখন ঘাটে যাইতে আরম্ভ করিল এবং পাড়া পৰ্যটন করিয়া আসিয়া কাশী মজুমদারের মেজো ছেলেটির প্রচুর ব্যাখ্যা করিতে লাগিল। ছিদামের দিন এবং রাত্রিগুলির মধ্যে কে যেন বিষ মিশাইয়া দিল। কাজে কমে' কোথাও এক দণ্ড গিয়া সুস্থির হইতে পারে না। একদিন ভাঙ্গকে আসিয়া ভারি ভৎসনা করিল। সে হাত নাড়িয়া ঝংকার দিয়া অনুপস্থিত মত পিতাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “ও মেয়ে ঝড়ের আগে ছোটে, উহাকে আমি সামলাইব ! আমি জানি, ও কোনদিন কী সবনাশ করিয়া বসিবে।” চন্দরা পাশের ঘর হইতে আসিয়া আস্তে আস্তে কহিল, "কেন দিদি, তোমার এত ভয় কিসের।” এই– দুই জায়ে বিষম বন্দ্ব বাধিয়া গেল। ছিদাম চোখ পাকাইয়া বলিল, "এবার যদি কখনো শনি তুই একলা ঘাটে গিয়াছিম, তোর হাড় গড়াইয়া দিব।” চন্দরা বলিল, “তাহা হইলে তো হাড় জড়ায়।" বলিয়া তৎক্ষণাং বাহিরে যাইবার উপক্ৰম করিল।