পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨08 গল্পগুচ্ছ নিস্তবধ অভিমান, লৌহভারের মতো সমস্ত ঘরকন্নার উপর অটলভাবে চাপিয়া রহিল। অবশেষে অসহ্য হইয়া উঠিলে অপব আসিয়া কহিল, “মা, কালেজ খুলেছে, এখন আমাকে আইন পড়তে যেতে হবে।” মা উদাসীন ভাবে কহিলেন, “বউয়ের কী করবে।" অপব কহিল, “বউ এখানেই থাক।” মা কহিলেন, "না বাপ কাজ নাই; তুমি তাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও।” সচরাচর মা অপবকে ‘তুই’ সম্প্রভাষণ করিয়া থাকেন। অপব অভিমানক্ষমস্বরে কহিল, “আচ্ছা।" কলিকাতা যাইবার আয়োজন পড়িয়া গেল। ষাইবার আগের রাত্রে অপব বিছানায় আসিয়া দেখিল, মন্ময়ী কাঁদিতেছে। হঠাৎ তাহার মনে আঘাত লাগিল। বিষন্নকঠে কহিল, ”মন্ময়ী, আমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে তোমার ইচ্ছে করছে না ?” মন্ময়ী কহিল, “না।” অপব জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি আমাকে ভালোবাস না ?" এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইল না। অনেক সময় এই প্রশ্নটির উত্তর অতিশয় সহজ কিন্তু আবার এক-এক সময় ইহার মধ্যে মনস্তত্ত্বঘটিত এত জটিলতার সংস্রব থাকে যে, বালিকার নিকট হইতে তাহার উত্তর প্রত্যাশা করা যায় না। অপব প্রশ্ন করিল, “রাখালকে ছেড়ে যেতে তোমার মন কেমন করছে ?” মন্ময়ী অনায়াসে উত্তর করিল, “হাঁ।” বালক রাখালের প্রতি এই বি. এ. -পরীক্ষোত্তীণ কৃতবিদ্য যুবকের সচির মতো অতি সক্ষয় অথচ অতি সতীক্ষ! ঈষার উদয় হইল। কহিল, “আমি অনেককাল আর বাড়ি আসতে পাব না।” এই সংবাদ সম্বন্ধে মন্ময়ীর কোনো বক্তব্য ছিল না । “বোধ হয় দ-বৎসর কিবা তাবও বেশি হতে পারে।” মন্ময়ী আদেশ করিল, “তুমি ফিরে আসবার সময় রাখলের জন্যে একটা তিনমাখো রজাসের ছুরি কিনে নিয়ে এসো।” অপব শয়ান অবস্থা হইতে ঈষৎ উত্থিত হইয়া কহিল, “তুমি তা হলে এইখানেই থাকবে ?” মন্ময়ী কহিল, “হাঁ, আমি মায়ের কাছে গিয়ে থাকব।" অপব নিশবাস ফেলিয়া কহিল, "আচ্ছা, তাই থেকো। যতদিন না তুমি আমাকে আসবার জন্যে চিঠি লিখবে, আমি আসব না। থব খুশি হলে ?” মন্ময়ী এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাহুল্য বোধ করিয়া ঘামাইতে লাগিল। কিন্তু অপবর ঘমে হইল না, বালিশ উচু করিয়া ঠেসান দিয়া বসিয়া রহিল। অনেক রাত্রে হঠাৎ চাঁদ উঠিয়া চাঁদের আলো বিছানার উপর আসিয়া পড়িল । অপব সেই আলোকে মন্ময়ীর দিকে চাহিয়া দেখিল। চাহিয়া চাহিয়া মনে হইল, যেন রাজকন্যাকে কে রপোর কাঠি ছোঁয়াইয়া অচেতন করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। একবার কেবল সোনার কাঠি পাইলেই এই নিদ্রিত আত্মাটিকে জাগাইয়া তুলিয়া মালাবদল করিয়া লওয়া যায়। রাপার কাঠি হাস্য, আর সোনার কাঠি অশ্রজল। ভোরের বেলায় অপব মন্ময়ীকে জাগাইয়া দিল: কাঁহল, “মন্ময়ী, আমার