পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミObf গল্পগুচ্ছ মনে মনে আরও অবজ্ঞা করিতেছে, ইহা ভাবিয়া সে শরবিন্ধের ন্যায় অন্তরে অন্তরে ছটফট করিতে লাগিল। দাসীকে বার বার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সে চিঠিখানা তুই কি ডাকে দিয়ে এসেছিস।” দাসী তাহাকে সহস্রবার আশ্বাস দিয়া কহিল, “হাঁ গো, আমি নিজের হাতে বাক্সের মধ্যে ফেলে দিয়েছি, বাব তা এতদিনে কোন কালে পেয়েছে।” অবশেষে অপবর মা একদিন মন্ময়ীকে ডাকিয়া কহিলেন, “বউমা, অপ অনেকদিন তো বাড়ি এল না, তাই মনে করছি, কলকাতায় গিয়ে তাকে দেখে আসি গে। তুমি সঙ্গে যাবে?” মন্ময়ী সম্মতিসচক ঘাড় নাড়িল এবং ঘরের মধ্যে আসিয়া বার রন্ধ করিয়া বিছানার উপর পড়িয়া বালিশখানা বকের উপর চাপিয়া ধরিয়া হাসিয়া নড়িয়া-চড়িয়া মনের আবেগ উন্মুক্ত করিয়া দিল; তাহার পর ক্ৰমে গম্ভীর হইয়া, বিষন্ন হইয়া, আশঙ্কায় পরিপন্ণ হইয়া, বসিয়া কাঁদিতে লাগিল। অপবকে কোনো খবর না দিয়া এই দটি অনন্তপ্ত রমণী তাহার প্রসন্নতা ভিক্ষা করিবার জন্য কলিকাতায় যাত্রা করিল। অপবর মা সেখানে তাঁহার জামাইবাড়িতে গিয়া উঠিলেন। সেদিন মন্ময়ীর পত্রের প্রত্যাশায় নিরাশ হইয়া সন্ধ্যাবেলায় অপব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া নিজেই তাহাকে পত্র লিখিতে বসিয়াছে। কোনো কথাই পছন্দমত হইতেছে না। এমন একটা সম্বোধন খুজিতেছে যাহাতে ভালোবাসাও প্রকাশ হয় অথচ অভিমানও ব্যক্ত করে; কথা না পাইয়া মাতৃভাষার উপর অশ্রদ্ধা দৃঢ়তর হইতেছে। এমন সময় ভগ্নীপতির নিকট হইতে পত্র পাইল, মা আসিয়াছেন, শীঘ্ৰ আসিবে এবং রাত্রে এইখানেই আহারাদি করিবে। সংবাদ সমস্ত ভালো।— শেষ আশ্বাস সত্ত্বেও আপবে: অমঙ্গলশঙ্কায় বিমষ হইয়া উঠিল। অবিলম্বে ভগ্নীর বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইল । সাক্ষাৎমাত্রই মাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মা, সব ভালো তো?" মা কহিলেন, “সব ভালো। তুই ছটিতে বাড়ি গেলি না, তাই আমি তোকে নিতে এসেছি।” অপব কহিল, “সেজন্য এত কষ্ট করিয়া আসিবার কী আবশ্যক ছিল : আইন পরীক্ষার পড়াশনা—” ইত্যাদি। আহারের সময় ভগ্নী জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, এবার বউকে তোমার সঙ্গে আনলে না কেন ।” দাদা গভীরভাবে কহিতে লাগিল, “আইনের পড়াশনা-" ইত্যাদি। ভগ্নীপতি হাসিয়া কহিল, “ও-সমস্ত মিথ্যা ওজর। আমাদের ভয়ে আনতে সাহস হয় না।” ভগ্নী কহিল, “ভয়ংকর লোকটাই বটে। ছেলেমানষে হঠাৎ দেখলে আচমকা তাঁকে উঠতে পারে।” এইভাবে হাস্যপরিহাস চলিতে লাগিল, কিন্তু অপব অত্যন্ত বিমৰ্ষ হইয়া রহিল। কোনো কথা তাহার ভালো লাগিতেছিল না। তাহার মনে হইতেছিল, সেই যখন মা পরিত। বোধ হয়, মা তাহাকে সঙ্গে আনিবার চেষ্টাও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে সম্মত হয় নাই। এ সম্বন্ধে সংকোচবশত মাকে কোনো প্রশ্ন কবিতে পারিল না-সমস্ত মানবজীবন এবং বিশ্ববরচনাটা আগাগোড়া ভ্রাতিসংকুল বলিয়া বোধ হইল।