পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খাতা ২১৭ বালিশের নীচে ও দিনের বেলা সবাদা তাহার কক্ষে ক্লোড়ে বিরাজ করিতে লাগিল। ছোটো বেণীটি বধিয়া, ঝি সঙ্গে করিয়া, যখন সে গ্রামের বালিকাবিদ্যালয়ে পড়িতে যাইত খাতাটি সঙ্গে সঙ্গে যাইত। দেখিয়া মেয়েদের কাহারও বিস্ময়, কাহারও লোভ, কাহারও বা বেষ হইত। প্রথম বৎসরে অতি যত্ন করিয়া খাতায় লিখিল— পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল। শয়নগহের মেঝের উপরে বসিয়া খাতাটি অকিড়িয়া ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে সর করিয়া পড়িত এবং লিখিত। এমনি করিয়া অনেক গদ্য পদ্য সংগ্ৰহ হইল। দ্বিতীয় বৎসরে মধ্যে মধ্যে দটি-একটি স্বাধীন রচনা দেখা দিতে লাগিল; অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত সারবান— ভূমিকা নাই, উপসংহার নাই। দটো-একটা উদ্ধত করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। খাতায় কথামালার ব্যাঘ্র ও বকের গল্পটা যেখানে কাপি করা আছে, তাহার নীচে এক জায়গায় একটা লাইন পাওয়া গেল, সেটা কথামালা কিবা বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের আর-কোথাও ইতিপবে দেখা যায় নাই। সে লাইনটি এই—যশিকে আমি খুব ভালোবাসি । কেহ না মনে করেন, আমি এইবার একটা প্রেমের গল্প বানাইতে বসিয়াছি। যশি পাড়ার কোনো একাদশ কিবা বাদশ -বষীয় বালক নহে। বাড়ির একটি পরাতন দাসী, তাহার প্রকৃত নাম যশোদা । কিন্তু, যশির প্রতি বালিকার প্রকৃত মনোভাব কী এই এক কথা হইতে তাহার কোনো দঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে যিনি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস লিখিতে ইচ্ছা করিবেন, তিনি এই খাতাতেই দী পাতা অন্তরে পাবোৰু কথাটির সপেস্ট প্রতিবাদ দেখিতে পাইবেন । এমন একটা-আধটা নয়, উমার রচনায় পদে পদে পরপরবিরোধিতা-দোষ লক্ষিত হয়। এক পথলে দেখা গেল— হরির সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি । (হরিচরণ নয়, হরিদাসী, বিদ্যালয়ের সহপাঠিকা।) তার অনতিদারেই এমন কথা আছে যাহা হইতে সহজেই বিশ্বাস জন্মে যে, হরির মতো প্রাণের বন্ধ তাহার আর ত্ৰিভুবনে নাই । তাহার পর-বৎসরে বালিকার বয়স যখন নয় বৎসর, তখন এক দিন সকালবেলা হইতে তাহাদের বাড়িতে সানাই বাজিতে লাগিল। উমার বিবাহ । বরটির নাম প্যারীমোহন, গোবিন্দলালের সহযোগী লেখক। বয়স যদিও অধিক নয় এবং লেখাপড়া কিঞ্চিং শেখা আছে, তথাপি নব্যভাব তার মনে কিছুমাত্র প্রবেশ করিতে পারে নাই। এইজন্য পাড়ার লোকেরা তাহাকে ধন্য ধন্য করিত এবং গোবিন্দলাল তাহার অনকেরণ করিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু সম্পণে কৃতকাষ হইতে পারে নাই। উমা বেনারসি শাড়ি পরিয়া, ঘোমটায় ক্ষুদ্র মুখখানি আবত করিয়া, কাঁদতে কাঁদিতে বশরেবাড়ি গেল। মা বলিয়া দিলেন, “বাছা, শাশুড়ির কথা মানিয়া চলিস, ঘরকন্নার কাজ করিস, লেখাপড়া লইয়া থাকিস নে ৷” গোবিন্দলাল বলিয়া দিলেন, “দেখিস, সেখানে দেয়ালে অাঁচড় কাটিয়া বেড়াসনে; সে তেমন বাড়ি নয়। আর, প্যারীমোহনের কোনো লেখার উপরে খবদার কলম চালাস নে।” বালিকার হাংকল্প উপস্থিত হইল। তখন বঝিতে পারিল, সে যেখানে যাইতেছে সেখানে কেহ তাহাকে মাজ’না করিবে না; এবং তাহারা কাহাকে দোষ বলে, অপরাধ