পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२०o গল্পগুচ্ছ তৃতীয় পরিচ্ছেদ কিন্তু গিরিবালার বাপ হরকুমারের সহিত শশিভূষণের ভালোর:প বনিবনাও হয় নাই। হরকুমার প্রথম প্রথম এই এম-এ বি-এলের নিকট মকদ্দমা মামলা সম্বন্ধে পরামর্শ লইতে আসিত। এম-এ বি-এল তাহাতে বড়ো-একটা মনোযোগ করিত না এবং আইনবিদ্যা সম্বন্ধে নায়েবের নিকট আপন অজ্ঞতা স্বীকার করিতে কুষ্ঠিত হইত না। নায়েব সেটাকে নিতান্তই ছল মনে করিত। এমনভাবে বছর দুয়েক কাটিল। সম্প্রতি একটা অবাধ্য প্রজাকে শাসন করা আবশ্যক হইয়াছে । নায়েব মহাশয় তাহার নামে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন অপরাধ ও দাবিতে নালিশ রাজ করিয়া দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া পরামশের জন্য শশিভূষণকে কিছু বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিলেন। শশিভূষণ পরামর্শ দেওয়া দরে থাক, শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে হরকুমারকে এমন গুটিদইচারি কথা বলিলেন যাহা তাঁহার কিছুমাত্র মিস্ট বোধ হইল না। এ দিকে আবার প্রজার নামে একটি মকদ্দমাতেও হরকুমার জিতিতে পারিলেন না। তাঁহার মনে দঢ় ধারণা হইল, শশিভূষণ উক্ত হতভাগ্য প্রজার সহায় ছিল ; তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন, এমন লোককে গ্রাম হইতে অবিলম্বেব তাড়াইতে হইবে । শশিভূষণ দেখিলেন, তাঁহার খেতের মধ্যে গোর প্রবেশ করে, তাঁহার কলাইয়ের খোলায় আগন লাগিয়া যায়, তাঁহার সীমানা লইয়া বিবাদ বাধে, তাঁহার প্রজারা সহজে খাজনা দেয় না এবং উলটিয়া তাঁহার নামে মিথ্যা মকদ্দমা আনিবার উপক্রম করে-- এমন কি সন্ধ্যার সময় পথে বাহির হইলে তাঁহাকে মারিবে এবং রাত্রে তাঁহার বসতবাটীতে আগন লাগাইয়া দিবে, এমন সকল জনশ্রুতিও শোনা যাইতে লাগিল । অবশেষে শান্তিপ্রিয় নিরীহপ্রকৃতি শশিভূষণ গ্রাম ছাড়িয়া কলিকাতায় পলাইবার আয়োজন করিলেন। যাত্রার উদ্যোগ করিতেছেন এমন সময়ে গ্রামে জয়েণ্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের তবি পড়িল। বরকন্দাজ কনস্টেবল খানসামা কুকুর ঘোড়া সহিস মেথরে সমস্ত গ্রাম চঞ্চল হইয়া উঠিল। ছেলের দল ব্যান্ত্রের অনুবতী শৃগালের পালের ন্যায় সাহেবের আন্ডার নিকটে শঙ্কিত কৌতুহল-সহকারে ঘুরিতে লাগিল। নায়েব মহাশয় যথারীতি আতিথ্য-শিরে খরচ লিখিয়া সাহেবের মাগি আন্ডা ঘত দগধ জোগাইতে লাগিলেন। জয়েন্ট সাহেবের যে পরিমাণে খাদ্য আবশ্যক নায়েব মহাশয় তদপেক্ষা অনেক বেশি অক্ষশ্নচিত্তে সরবরাহ করিয়াছিলেন, কিন্তু প্রাতঃকালে সাহেবের মেথর আসিয়া যখন সাহেবের কুকুরের জন্য একেবারে চার সের ঘত আদেশ করিয়া বসিল তখন দরগ্রহবশত সেটা তাঁহার সহ্য হইল না— মেথরকে উপদেশ দিলেন যে, সাহেবের কুত্তা যদিচ দেশি কুকুরের অপেক্ষা অনেকটা ঘি বিনা পরিতাপে হজম করিতে পারে তথাপি এতাধিক পরিমাণে স্নেহপদার্থ তাহার সবাস্থ্যের পক্ষে কল্যাণজনক নহে। তাহাকে ঘি দিলেন না । মেথর গিয়া সাহেবকে জানাইল যে, কুকুরের জন্য মাংস কোথায় পাওয়া যাইতে পারে ইহাই সে নায়েবের নিকট সন্ধান লইতে গিয়াছিল, কিন্তু সে জাতিতে মেথর বলিয়া নায়েব অবজ্ঞাপবেক তাহাকে সবলোকসমক্ষে দরে করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে, এমন কি, সাহেবের প্রতিও উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই।