পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ক্ষধিত পাষাণ ෆ`` প্রস্তরের প্রাসাদ শৈলপদমলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে—নিকটে কোথাও লোকালয় নাই। বরীচের তুলার হাট এবং গ্রাম এখান হইতে দারে। প্রায় আড়াই শত বৎসর পবে দ্বিতীয় শা-মামদ ভোগবিলাসের জন্য প্রাসাদটি এই নিজন পথানে নিমাণ করিয়াছিলেন। তখন হইতে নানশালার ফোয়ারার মুখ হইতে গোলাপগন্ধি জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকরশীতল নিভূত গাহের মধ্যে মম'রখচিত সিনগধ শিলাসনে বসিয়া, কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নিমল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া, তরণী পারসিক রমণীগণ নানের প্রবে: কেশ মুক্ত করিয়া দিয়া, সেতার কোলে, দ্রাক্ষাবনের গজল গান করিত। এখন আর সে ফোয়ারা খেলে না, সে গান নাই, সাদা পাথরের উপর শত্র চরণের সন্দের আঘাত পড়ে না-- এখন ইহা আমাদের মতো নিজনিবাসপীড়িত সঙ্গিনীহীন মাশল-কালেক্টরের অতি বহৎ এবং অতি শান্য বাসস্থান । কিন্তু আপিসের বন্ধ কেরানি করিম খাঁ আমাকে এই প্রাসাদে বাস করিতে বারবার নিষেধ করিয়াছিল। বলিয়াছিল, “ইচ্ছা হয় দিনের বেলা থাকিবেন, কিন্তু কখনও এখানে রাত্রিযাপন করিবেন না।” আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম। ভূত্যেরা বলিল, তাহারা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করিবে কিন্তু রাত্রে এখানে থাকিবে না। আমি বলিলাম, “তথাস্তু।” এ বাড়ির এমন বদনাম ছিল যে, রাতে চোরও এখানে আসিতে সাহস করিত না । প্রথম প্রথম আসিয়া এই পরিত্যন্ত পাষাণপ্রাসাদের বিজনতা আমার বকের উপর যেন একটা ভয়ংকর ভারের মতো চাপিয়া থাকিত, আমি যতটা পারিতাম বাহিরে থাকিয়া, অবিশ্রাম কাজকম করিয়া, রাত্রে ঘরে ফিরিয়া শ্রান্তদেহে নিদ্রা দিতাম । কিন্তু সপ্তাহখানেক না যাইতেই বাড়িটার এক অপব নেশা আমাকে ক্রমশ আক্রমণ করিয়া ধরিতে লাগিল। আমার সে অবস্থা বণনা করাও কঠিন এবং সে কথা লোককে বিশ্বাস করানোও শক্ত। সমস্ত বাড়িটা একটা সজীব পদার্থের মতো আমাকে তাহার জঠরস্থ মোহরসে অল্পে আশেপ যেন জীণ করিতে লাগিল। বোধ হয় এ বাড়িতে পদাপণমাত্রেই এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল— কিন্তু আমি যেদিন সচেতনভাবে প্রথম ইহার সত্রপাত অনুভব করি সেদিনকার কথা আমার পস্ট মনে আছে । তখন গ্রীষ্মকালের আরম্ভে বাজার নরম ; আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না । সন্যাস্তের কিছু পাবে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরামকেদারা লইয়া বসিয়াছি। তখন শস্তো নদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে ; ওপারে অনেকখানি বালতট অপরাহের আভায় রঙিন হইয়া উঠিয়াছে, এপারে ঘাটের সোপানমলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নড়িগুলি কিক কিক করিতেছে। সেদিন কোথাও বাতাস ছিল না। নিকটের পাহাড়ে বনতুলসী পদিনা ও মৌরির জঙ্গল হইতে একটা ঘন সুগন্ধ উঠিয়া সিথর আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল। সন্য যখন গিরিশিখরের অন্তরালে অবতীণ হইল, তৎক্ষণাৎ দিবসের নাট্যশালায় একটা দীঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল—এখানে পবতের বাবধান থাকাতে সন্যাস্তের সময় আলো-অাঁধারের সম্মিলন অধিকক্ষণ পথায়ী হয় না । ঘোড়ায় চড়িয়া একবার ছটিয়া বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব-উঠিব করিতেছি, এমন সময়ে সিড়িতে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম— কেহ নাই।