পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ෆථ8 গল্পগুচ্ছ উচ্ছলিত হইতে থাকিত তখন হঠাৎ চার দ্রতপদে বিছানা হইতে উঠিয়া আসিয়া সরোষ-সরোদনে বলিত, “মা, তোমরা কী গোল করছ, আমার ঘন্ম হচ্ছে না।" পিতামাতা তাহাকে একলা ঘামাইতে পাঠাইয়া তারাপদকে ঘিরিয়া সংগীত উপভোগ করিতেছেন ইহা তাহার একান্ত অসহ্য হইয়া উঠিত। এই দীপ্তকৃষ্ণনয়না বালিকার স্বাভাবিক সতীব্রতা তারাপদর নিকটে অত্যন্ত কৌতুকজনক বোধ হইত। সে ইহাকে গল্প শনাইয়া, গান গাহিয়া, বশি বাজাইয়া, বশ করিতে অনেক চেষ্টা করিল কিন্তু কিছুতেই কৃতকাষ হইল না। কেবল তারাপদ মধ্যাহ্নে যখন নদীতে স্নান করিতে নামিত, পরিপণ জলরাশির মধ্যে গৌরবণ সরল তন্যদেহখানি নানা সন্তরণভঙ্গিতে অবলীলাক্রমে সঞ্চালন করিয়া তরণে জলদেবতার মতো শোভা পাইত, তখন বালিকার কৌতুহল আকৃষ্ট না হইয়া থাকিত না ; সে সেই সময়টির জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকিত ; কিন্তু আন্তরিক আগ্রহ কাহাকেও জানিতে দিত না, এবং এই অশিক্ষাপট অভিনেত্রী পশমের গলাবন্ধ বোনা একমনে অভ্যাস করিতে করিতে মাঝে মাঝে যেন অত্যন্ত উপেক্ষাভরে কটাক্ষে তারাপদর সন্তরণলীলা দেখিয়া লইত। চতুর্থ পরিচ্ছেদ নন্দীগ্রাম কখন ছাড়াইয়া গেল তারাপদ তাহার খোঁজ লইল না। অত্যন্ত মন্দমন্দ গতিতে বহং নৌকাখানা কখনও পাল তুলিয়া, কখনও গণ টানিযা, নানা নদীর শাখাপ্রশাখার ভিতর দিয়া চলিতে লাগিল; নৌকারোহীদের দিনগুলিও এই-সকল নদী-উপনদীর মতো শান্তিময় সৌন্দর্যময় বৈচিত্রোর মধ্য দিয়া সহজ সৌম্য গমনে মদমিস্ট কলম্বরে প্রবাহিত হইতে লাগিল। কাহারও কোনোরপে তাড়া ছিল না মধ্যাহ্নে সনানাহারে অনেকক্ষণ বিলম্বব হইত ; এ দিকে, সন্ধ্যা হইতে না হইতেই একট: বড়ো দেখিয়া গ্রামের ধারে, ঘাটের কাছে, ঝিল্লিমন্দ্রিত খদোতখচিত বনের পাশেব নৌকা বধিত। এমনি করিয়া দিনদশেকে নৌকা কাঁঠালিয়ায় পৌছিল। জমিদারের আগমনে বাড়ি হইতে পালকি এবং টাটঘোড়ার সমাগম হইল এবং বাঁশের লাঠি হতে পাইক বরকল্দাজের দল ঘন ঘন বন্দকের ফাঁকা আওয়াজে গ্রামের উৎকণ্ঠিত কাকসমাজকে যৎপরোনাসিত মুখর করিয়া তুলিল। এই-সমস্ত সমারোহে কালবিলম্বল হইতেছে, ইতিমধ্যে তারাপদ নৌকা হইতে দ্রত নামিয়া একবার সমস্ত গ্রাম পৰ্যটন করিয়া লইল। কাহাকেও দাদা, কাহাকেও খড়া, কাহাকেও দিদি, কাহাকেও মাসি বলিয়া দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত গ্রামের সহিত সোঁহাদ্য-বন্ধন স্থাপিত করিয়া লইল। কোথাও তাহার প্রকৃত কোনো বন্ধন ছিল না বলিয়াই এই বালক আশ্চৰ্য সত্বর ও সহজে সকলেরই সহিত পরিচয় করিয়া লইতে পারিত। তারাপদ দেখিতে দেখিতে অলপ দিনের মধ্যেই গ্রামের সমস্ত হাদয় অধিকার করিয়া লইল । এত সহজে হৃদয় হরণ করিবার কারণ এই, তারাপদ সকলেরই সঙ্গে তাহদের নিজের মতো হইয়া স্বভাবতই যোগ দিতে পারিত। সে কোনোপ্রকার বিশেষ সংস্কারের