পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ළු8දෘ দরাশা দাজিলিঙে গিয়া দেখিলাম, মেঘে বাটিতে দশ দিক আচ্ছন্ন। ঘরের বাহির হইতে ইচ্ছা হয় না, ঘরের মধ্যে থাকিতে আরও অনিচ্ছা জন্মে। হোটেলে প্রাতঃকালের আহার সমাধা করিয়া পায়ে মোটা বট এবং আপাদমস্তক ম্যাকিনটশ পরিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছি। ক্ষণে ক্ষণে টিপ টপ করিয়া ব্যটি পড়িতেছে এবং সবন্ত ঘন মেঘের কুঙ্কটিকায় মনে হইতেছে যেন বিধাতা হিমালয় পবীত-সন্ধ সমস্ত বিশবচিত্র রবার দিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া মছিয়া ফেলিবার উপক্ৰম করিয়াছেন। জনশন ক্যালকাটা রোডে একাকী পদচারণ করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম— অবলম্বনহীন মেঘরাজ্যে আর তো ভালো লাগে না, শব্দপশারপেময়ী বিচিত্রা ধরণীমাতাকে পুনরায় পাঁচ ইন্দ্রিয় বারা পাঁচ রকমে অকিড়িয়া ধরিবার জন্য প্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে । এমন সময়ে অনতিদরে রমণীকন্ঠের সকরণ রোদনগঞ্জনধননি শুনিতে পাইলাম । রোগশোকসংকুল সংসারে রোদনধৰ্মনিটা কিছুই বিচিত্র নহে, অন্যত্র অন্য সময় হইলে ফিরিয়া চাহিতাম কি না সন্দেহ, কিন্তু এই অসীম মেঘরাজ্যের মধ্যে সে রোদন সমস্ত লতে জগতের একমাত্র রোদনের মতো আমার কানে আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া মনে হইল না। শব্দ লক্ষ্য করিয়া নিকটে গিয়া দেখিলাম গৈরিকবসনাবতী নারী, তাহার মস্তকে সবণ কপিশ জটাভার চড়া-আকারে আবদ্ধ, পথপ্রান্তে শিলাখন্ডের উপর বসিয়া মদম্বেরে ক্ৰন্দন করিতেছে। তাহা সদ্যশোকের বিলাপ নহে, বহুদিনসঞ্চিত নিঃশব্দ শ্রান্তি ও অবসাদ আজ মেঘান্ধকার নিজনতার ভারে ভাঙিয়া উচ্ছসিত হইয়া পড়িতেছে। মনে মনে ভাবিলাম, এ বেশ হইল, ঠিক যেন ঘর-গড়া গল্পের মতো আরম্ভ হইল ; পবতশৃঙ্গে সন্ন্যাসিনী বসিয়া কাঁদিতেছে ইহা যে কখনও চমচক্ষে দেখিব এমন আশা কস্মিনকালে ছিল না। মেয়েটি কোন জাত ঠাহর হইল না। সদয় হিন্দি ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে তুমি, তোমার কী হইয়াছে।” প্রথমে উত্তর দিল না, মেঘের মধ্য হইতে সজলদীপতনেত্রে আমাকে একবার দেখিয়া লইল । আমি আবার কহিলাম, “আমাকে ভয় করিয়ো না। আমি ভদ্রলোক।” শনিয়া সে হাসিয়া খাস হিন্দুস্থানীতে বলিয়া উঠিল, “বহুদিন হইতে ভয়ডরের মাথা খাইয়া বসিয়া আছি, লন্জাশরমও নাই। বাবজি, একসময় আমি যে জেনানায় ছিলাম সেখানে আমার সহোদর ভাইকে প্রবেশ করিতে হইলেও অনুমতি লইতে হইত, আঞ্জ বিশ্বসংসারে আমার পদা নাই।” প্রথমটা একট রাগ হইল ; আমার চালচলন সমস্তই সাহেবি। কিন্তু এই হতভাগিনী বিনা বিধায় আমাকে বাবজি সবোধন করে কেন। ভাবিলাম, এইখানেই আমার