পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ළු89 গল্পগুচ্ছ উপন্যাস শেষ করিয়া সিগারেটের ধোঁয়া উড়াইয়া উদ্যতনাসা সাহেবিয়ানার রেলগাড়ির মতো সশব্দে সবেগে সদপে প্রস্থান করি। অবশেষে কৌতুহল জয়লাভ করিল। আমি কিছ উচ্চভাব ধারণ করিয়া বক্রগ্রীবায় জিজ্ঞাসা করিলাম, "তোমাকে কিছু সাহায্য করিতে পারি ? তোমার কোনো প্রাথনা আছে ?” সে স্থিরভাবে আমার মুখের দিকে চাহিল এবং ক্ষণকাল পরে সংক্ষেপে উত্তর করিল, “আমি বদ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খাঁর পত্রী।" বন্দ্ৰাওন কোন মল্লকে এবং নবাব গোলামকাদের খাঁ কোন নবাব এবং তাঁহার কন্যা যে কী দঃখে সন্ন্যাসিনীবেশে দাজিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে বসিয়া কাঁদিতে পারে আমি তাহার বিন্দবিসগ জানি না এবং বিশ্বাসও করি না, কিন্তু ভাবিলাম রসভঙ্গ করিব না, গল্পটি দিব্য জমিয়া আসিতেছে। তৎক্ষণাৎ স্যগম্ভীর মুখে সন্দীঘ সেলাম করিয়া কহিলাম, "বিবিসাহেব, মাপ করো, তোমাকে চিনিতে পারি নাই।” চিনিতে না পারিবার অনেকগুলি যুক্তিসংগত কারণ ছিল, তাহার মধ্যে সব প্রধান কারণ, তাঁহাকে পাবে কস্মিনকালে দেখি নাই, তাহার উপর এমনি কুয়াশা যে নিজের হাত পা কয়খানিই চিনিয়া লওয়া দুঃসাধ্য। বিবিসাহেবও আমার অপরাধ লইলেন না এবং সন্তুষ্টকন্ঠে দক্ষিণহস্তের ইঙ্গিতে স্বতন্ত্র শিলাখণ্ড নিদেশ করিয়া আমাকে অনুমতি করিলেন, “বৈঠিয়ে ।” দেখিলাম, রমণীটির আদেশ করিবার ক্ষমতা আছে । আমি তাঁহার নিকুট হইতে সেই সিক্ত শৈবালাচ্ছন্ন কঠিনবন্ধর শিলাখণ্ডতলে আসন গ্রহণের সম্মতি প্রাপ্ত হইয়া এক অভাবনীয় সম্মান লাভ করিলাম। বদ্রাওনের গোলামকাদের খাঁর পত্রী নরউল্লীসা বা মেহেরউন্নীসা বা নর-উল-মুলক আমাকে দাজিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে তাহার অনতিদরবতী অনতি-উচ্চ পকিল আসনে বসিবার অধিকার দিয়াছেন । হোটেল হইতে ম্যাকিন্টশ পরিয়া বাহির হইবার সময় এমন সমহং সম্পভাবনা আমার সবনেরও অগোচর ছিল। হিমালয়বক্ষে শিলাতলে একান্তে দুইটি পাথ নরনারীর রহস্যালাপকাহিনী সহসা সদ্যসম্পণে কবোষ্ণ কাব্যকথার মতো শুনিতে হয়, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দর্যগত নিজন গিরিকন্দরের নিঝরপ্রপাতধননি এবং কালিদাস-রচিত মেঘদত-কুমারসম্বভবের বিচিত্র সংগীতমমরি জাগ্রত হইয়া উঠিতে থাকে, তথাপি এ কথ্য সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, বট এবং ম্যাকিন্টশ পরিয়া কালকাটা রোডের ধারে কদমাসনে এক দীনবেশিনী হিন্দুস্থানী রমণীর সহিত একত্র উপবেশন-পব’ক সম্পণে আত্মগৌরব অক্ষণভাবে অনুভব করিতে পারে এমন নবাবগ অতি অল্পই আছে । কিন্তু সেদিন ঘনঘোর বাপে দশ দিক আবত ছিল, সংসারের নিকট চক্ষালজা রাখিবার কোনো বিষয় কোথাও ছিল না, কেবল অনন্ত মেঘরাজ্যের মধ্যে বদ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খাঁর পত্রী এবং আমি-- এক নববিকশিত বাঙালি সাহেব - দুইজনে দইখানি প্রস্তরের উপর বিশ্বজগতের দইখণ্ড প্রলয়াবশেষের ন্যায় অবশিষ্ট ছিলাম, এই বিসদশ সম্মিলনের পরম পরিহাস কেবল আমাদের অদন্টের গোচর ছিল, কাহারও দন্টিগোচর ছিল না। আমি কহিলাম, “বিবিসাহেব, তোমার এ হাল কে করিল।”