পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজটিকা ●bfa অর্ণলেখা বারবার বলিতে লাগিল, “ন। দিদি, আর যা-ই হই, আমি রায়বাহাদরনী হইতে পারিব না।” আসল কথা, অরণের পরিচিত ভূতনাথবাব রায়বাহাদর ছিলেন, পদবীটার প্রতি আন্তরিক আপত্তির কারণ তাহাই । লাবণ্য অনেক আশ্বাস দিয়া কহিল, “আচ্ছা, তোকে সেজন্য ভাবিতে হইবে না।” বক্সারে লাবণ্যর স্বামী নীলরতন কাজ করিতেন। শরতের অবসানে নবেন্দর সেখান হইতে লাবণ্যর নিমন্ত্রণ পাইলেন। সানন্দচিত্তে অনতিবিলম্বে গাড়ি চড়িয়া যারা করিলেন। রেলে চড়িবার সময় তাঁহার বামাঙ্গ কপিল না, কিন্তু তাহা হইতে কেবল এই প্রমাণ হয় যে, আসন্ন বিপদের সময় বামাঙ্গ কপিাটা একটা আমলেক কুসংস্কারমান্ত । লাবণ্যলেখা পশ্চিম প্রদেশের নবশীতাগমসক্তৃত বাস্থা এবং সৌন্দয্যের অরণে পাণ্ডুরে পণপরিসফট হইয়া নিমল শরৎকালের নিজাননদীকললালিত অম্বলানপ্রফুল্লা কাশবনশ্রীর মতো হাস্যে ও হিল্লোলে ঝলমল করিতেছিল। নবেন্দর মধে দষ্টির উপরে যেন একটি পণপপিতা মালতীলতা নবপ্রভাতের শীতোঙ্গজল শিশিরকণা ঝলকে ঝলকে বর্ষণ করিতে লাগিল । মনের আনন্দে এবং পশ্চিমের হাওয়ায় নবেন্দর অজীণ রোগ দরে হইয়া গেল । সবাস্থ্যের নেশায়, সৌন্দয্যের মোহে এবং শ্যালীহস্তের শশ্রেষাপলকে সে যেন মাটি ছাড়িয়া আকাশের উপর দিয়া চলিতে লাগিল। তাহাদের বাগানের সম্মুখ দিয়া পরিপণ গঙ্গা যেন তাহারই মনের দরক্ত পাগলামিকে আকার দান করিয়া বিষম গোলমাল করিতে করিতে প্রবল আবেগে নিরদেশ হইয়া চলিয়া যাইত । ভোরের বেলা নদীতীরে বেড়াইয়া ফিরিবার সময় শীতপ্রভাতের স্নিগ্ধ রৌদ্র যেন প্রিয়মিলনের উত্তাপের মতো তাহার সমস্ত শরীরকে চরিতাথ করিয়া দিত। তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া শ্যালীর শখের রন্ধনে জোগান দিলার ভার লইয়া নবেন্দর অজ্ঞতা ও অনৈপুণ্য পদে পদে প্রকাশ পাইতে থাকিত । কিন্তু অভাস ও মনোযোগের বারা উত্তরোত্তর তাহা সংশোধন করিয়া লইবার জন্য মঢ়ে অনভিক্তের কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না ; কারণ, প্রত্যহ নিজেকে অপরাধী করিয়া সে যে-সকল তাড়না ভৎসনা লাভ করিত তাহাতে কিছুতেই তাহার তৃপ্তির শেষ হইত না । যথাযথ পরিমাণে মালমসলা বিভাগ, উনান হইতে হাঁড়ি তোলা-নামা, উত্তাপাধিক্যে ব্যঞ্জন পড়িয়া না যায় তাহার যথোচিত ব্যবস্থা— ইত্যাদি বিষয়ে সে যে সদ্যোজাত শিশরে মতো অপট অক্ষম এবং নিরপোয় ইহাই প্রত্যহ বলপবেক প্রমাণ করিয়া নবেন্দ শ্যালীর কৃপামিশ্রিত হাস্য এবং হাস্যমিশ্রিত লাঞ্ছনা মনের সুখে ভোগ করিত। মধ্যাহ্নে এক দিকে ক্ষুধার তাড়না অন্য দিকে শ্যালীর পীড়াপীড়ি, নিজের আগ্রহ এবং প্রিয়জনের ঔৎসুক্য, রন্ধনের পারিপাট্য এবং রন্ধনীর সেবামাধব, উভয়ের সংযোগে ভোজন-ব্যাপারের ওজন রক্ষা করা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিত। আহারের পর সামান্য তাস খেলাতেও নবেন্দ প্রতিভার পরিচয় দিতে পারিত না। চুরি করিত, হাতের কাগজ দেখিত, কাড়াকড়ি বকাবাঁক বাধাইয়া দিত কিন্তু তব, জিতিতে পারিত না। না জিতিলেও জোর করিয়া তাহার হার অস্বীকার করিত এবং সেজন্য প্রত্যহ তাহার গঞ্জনার সীমা থাকিত না; তথাপিও পাষণ্ড আত্মসংশোধনচেষ্টায় সম্পণে উদাসীন ছিল।