পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○>O গল্পগুচ্ছ হইল। একট ক্ষম হইয়া কহিল, “তুমি মনে করিতেছ, প্রতিবাদ করিতে আমি ভয় वर्गद्र !” লাবণ্য কহিল, “তা কেন! আমি ভাবিতেছিলাম, তোমার অনেক আশাভরসার সেই ঘোড়দৌড়ের মাঠখানি বাঁচাইবার চেস্টা এখনও ছাড় নাই— যতক্ষণ বাস ততক্ষণ আশ ।” নবেন্দ কহিল, “আমি বুঝি সেইজন্য লিখিতে চাহি না!" অত্যন্ত রাগিয়া দোয়াতকলম লইয়া বসিল। কিন্তু, লেখার মধ্যে রাগের রক্তিমা বড়ো প্রকাশ পাইল না, কাজেই লাবণ্য ও নীলরতনকে সংশোধনের ভার লইতে হইল। যেন লুচিভাজার পালা পড়িল; নবেন্দ যেটা জলে ও ঘিয়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা নরম নরম করিয়া এবং চাপিয়া যথাসাধ্য চেপ্টা করিয়া বেলিয়া দেয় তাঁহার দুই সহকারী তৎক্ষণাৎ সেটাকে ভাজিয়া কড়া ও গরম করিয়া ফলাইয়া ফলাইয়া তোলে। লেখা হইল যে, আত্মীয় যখন শহর হয় তখন বহিঃশত্র অপেক্ষা ভয়ংকর হইয়া উঠে। পাঠান অথবা রাশিয়ান ভারতগবমেন্টের তেমন শত্র নহে যেমন শত্র গবোন্ধত অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সম্প্রদায়। গবমেন্টের সহিত প্রজাসাধারণের নিরাপদ সোঁহাদাবন্ধনের তাহারাই দুভোদ্য অন্তরায়। কনগ্রেস রাজা ও প্রজার মাঝখানে সথায়ী সদ্ভাবসাধনের যে প্রশস্ত রাজপথ খালিয়াছে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাগজগুলো ঠিক তাহার মধ্যস্থল জড়িয়া একেবারে কণ্টকিত হইয়া রহিয়াছে। ইত্যাদি। নবেন্দর ভিতরে ভিতরে ভয়-ভয় করিতে লাগিল অথচ লেখাটা বড়ো সরেস হইয়াছে মনে করিয়া, রহিয়া রহিয়া একটা আনন্দও হইতে লাগিল। এমন সন্দের রচনা তাহার সাধ্যাতীত ছিল। ইহার পর কিছুদিন ধরিয়া নানা কাগজে বিবাদবিসবাদ-বাদপ্রতিবাদে নবেন্দর চাঁদা এবং কনগ্রেসে যোগ দেওয়ার কথা লইষা দশ দিকে ঢাক বাজিতে লাগিল। নবেন্দ এক্ষণে মরিয়া হইয়া কথায় বাতায শালীসমাজে অত্যন্ত নিভীক দেশহিতৈষী হইয়া উঠিল। লাবণ্য মনে মনে হাসিয়া কহিল, “এখনও তোমার অগ্নিপরীক্ষা বাকি আছে।” একদিন প্রাতঃকালে নবেন্দ নানের পবে বক্ষস্থল তৈলাক্ত করিয়া পৃষ্ঠদেশের দগম অংশগুলিতে তৈলসঞ্চার করিবার কৌশল অবলম্বন করিতেছেন এমনসময় বেহারা এক কাড হাতে করিয়া তাঁহাকে দিল, তাহাতে স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটের নাম অাঁকা । লাবণ্য সহাস্যকুতহেলী চক্ষে আড়াল হইতে কৌতুক দেখিতেছিল। তৈললাঞ্ছিত কলেবরে তো ম্যাজিস্টেটের সহিত সাক্ষাৎ করা যায় না—নবেন্দ ভাজিবার পাবে মসলা-মাখা কই-মৎস্যের মতো ব্যথা ব্যতিব্যস্ত হইতে লাগিলেন। তাড়াতাড়ি চকিতের মধ্যে সনান করিয়া কোনোমতে কাপড় পরিয়া উধাবাসে বাহিরের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। বেহারা বলিল, "সাহেব অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চলিয়া গিয়াছেন।” এই আগাগোড়া মিথ্যাচরণ-পাপের কতটা অংশ লেহারার, কতটা অংশ বা লাবণোর, তাহা নৈতিক গণিতশাস্ত্রের একটা সক্ষম সমস্যা। টিকটিকির কাটা লেজ যেমন সম্পণ অন্ধভাবে ধড়ফড় করে নবেন্দর ক্ষৰ হাদয় ভিতরে ভিতরে তেমনি আছাড় খাইতে লাগিল। সমস্ত দিন খাইতে শইতে আর সোয়াসিত রহিল না।