পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মণিহারা 806; বারীশান্য দেউড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল, শব্দ জনশন্য অন্তঃপরের গোলসিড়ির মধ্য দিয়া ঘরিয়া ঘরিয়া উঠিতে লাগিল, শব্দ দীঘ বারান্দা পার হইল, এবং শয়নকক্ষের বারের কাছে আসিয়া ক্ষণকালের জন্য থামিল। ফণিভূষণের হদয় ব্যাকুল এবং সবাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে চক্ষ খলিল না। শব্দ চৌকাঠ পার হইয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আলনায় যেখানে শাড়ি কোঁচানো আছে, কুলুঙ্গিতে যেখানে কেরোসিনের দীপ দাঁড়াইয়া, টিপাইয়ের ধারে যেখানে পানের বাটায় পান শাক, এবং সেই বিচিত্র সামগ্রীপণ আলমারির কাছে প্রত্যেক জায়গায় এক-একবার করিয়া দাঁড়াইয়া অবশেষে শব্দটা ফণিভূষণের অত্যন্ত কাছে আসিয়া থামিল। তখন ফণিভূষণ চোখ মেলিল এবং দেখিল, ঘরে নবেদিত দশমীর চন্দ্রলোক আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মখে একটি কঙ্কাল দাঁড়াইয়া । সেই ককালের আট আঙলে আংটি, করতলে রতনচক, প্রকোষ্ঠে বালা, বাহতে বাজবন্ধ, গলায় কণ্ঠি, মাথায় সিথি, তাহার আপাদমস্তকে অস্থিতে অস্থিতে একএকটি আভরণ সোনায় হীরার ঝকঝকা করিতেছে। অলংকারগুলি ঢিলা, ঢলঢল করিতেছে, কিন্তু অঙ্গ হইতে খসিয়া পড়িতেছে না। সবাপেক্ষা ভয়ংকর, তাহার অস্থিময় মুখে তাহার দই চক্ষ ছিল সজীব; সেই কালো তারা, সেই ঘন দীঘ" পক্ষয়, সেই সজল উজ্জলতা, সেই অবিচলিত দঢ়শান্ত দটি। আজ আঠারো বৎসর পবে একদিন আলোকিত সভাগহে নহবতের সাহানা-আলাপের মধ্যে ফণিভূষণ যে দটি আয়ত সন্দের কালো-কালো ঢলঢল চোখ শভেদটিতে প্রথম দেখিয়াছিল সেই দটি চক্ষই আজ শ্রাবণের অধরাত্রে কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চন্দ্রকিরণে দেখিল, দেখিয়া তাহার সব শরীরের রক্ত হিম হইয়া আসিল। প্রাণপণে দুই চক্ষ বজিতে চেষ্টা করিল, কিছুতেই পারিল না; তাহার চক্ষ মত মানুষের চক্ষর মতো নিনিমেষ চাহিয়া রহিল। তখন সেই ককাল সতভিত ফণিভূষণের মখের দিকে তাহার দটি স্থির রাখিয়া দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া নীরবে অগলিসংকেতে ডাকিল। তাহার চার আঙুলের অস্থিতে হীরার আংটি ঝকমক করিয়া উঠিল। ফণিভূষণ মঢ়ের মতো উঠিয়া দাঁড়াইল। কঙ্কাল বারের অভিমুখে চলিল; হাড়েতে হাড়েতে গহনায় গহনায় কঠিন শব্দ হইতে লাগিল। ফণিভূষণ পাশবন্ধ পত্তলীর মতো তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। বারান্দা পার হইল, নিবিড় অন্ধকার গোলসিড়ি ঘরিয়া ঘরিয়া খটখট ঠকঠক কম কম করিতে করিতে নীচে উত্তীণ হইল। নিচেকার বারান্দা পার হইয়া জনশন্য দীপহীন দেউড়িতে প্রবেশ করিল; অবশেষে দেউড়ি পার হইয়া ইটের-খোয়া-দেওয়া বাগানের রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। খোয়াগলি অস্থিপাতে কড়াকড় করিতে লাগিল। সেখানে ক্ষীণ জ্যোৎস্না ঘন ডালপালার মধ্যে আটক খাইয়া কোথাও নিরুতির পথ পাইতেছিল না; সেই কষার নিবিড়গলৰ অন্ধকার ছায়াপথে জোনাকির ঝাঁকের মধ্য দিয়া উভয়ে নদীর ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘাটের যে ধাপ বাহিয়া শব্দ উপরে উঠিয়াছিল সেই ধাপ দিয়া অলংকৃত ককাল তাহার আন্দোলনহীন ঋজগতিতে কঠিন শঙ্গ করিয়া এক-পা এক-পা নামিতে লাগিল। পরিপাণ" বর্ষ নদীর প্রবলস্রোত জলের উপর জ্যোৎস্নার একটি দীঘরেখা