পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8>しf গল্পগুচ্ছ আমার সম্মখে প্রকাশ হইবে। ছেলেপলে নাই কেন।” আমি ঈষৎ হাসিয়া কহিলাম, "কেন তাহা কী করিয়া জানিব, ঈশ্বর দেন নাই।” হেমাঙ্গিনী কহিল, “অবশ্য তোমার ভিতরে কিছু পাপ ছিল।” আমি কহিলাম, “তাহাও অন্তযামী জানেন।” বালিকা প্রমাণস্বরপে কহিল, “দেখো-না, কাকির ভিতরে এত কুটিলতা যে উহার গভে সন্তান জমিতে পায় না।” পাপপণ্য সখদঃখ দণ্ডপরস্কারের তত্ত্ব নিজেও বুঝি না, বালিকাকেও বঝোইলাম না; কেবল একটা নিশবাস ফেলিয়া মনে-মনে তাঁহাকে কহিলাম, তুমিই জান! হেমাঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “ওমা, আমার কথা শুনিয়াও তোমার নিশবাস পড়ে! আমার কথা বুঝি কেহ গ্রাহ্য করে!” দেখিলাম, স্বামীর ডাক্তারি-ব্যবসায়ে ব্যাঘাত হইতে লাগিল। দরে ডাক পড়িলে তো যানই না, কাছে কোথাও গেলেও চটপট সারিয়া চলিয়া আসেন। পবে যখন কমের অবসরে ঘরে থাকিতেন, মধ্যাহ্নে আহার এবং নিদ্রার সময়ে কেবল বাড়ির ভিতরে আসিতেন। এখন পিসিমাও যখন-তখন ডাকিয়া পাঠান, তিনিও অনাবশ্যক পিসিমার খবর লইতে আসেন। পিসিমা যখন ডাক ছাড়িয়া বলেন, “হিম, আমার পানের বাটাটা নিয়ে আয় তো”, আমি বুঝিতে পারি পিসিমার ঘরে আমার স্বামী আসিয়াছেন। প্রথম প্রথম দিন-দুইতিন হেমাঙ্গিনী পানের বাটা, তেলের বাটি, সিদরের কোঁটো প্রভৃতি যথাদিষ্ট লইয়া যাইত। কিন্তু, তাহার পরে ডাক পড়িলে সে আর কিছতেই নড়িত না, ঝির হাত দিয়া আদিষ্ট দ্রব্য পাঠাইয়া দিত। পিসি ডাকিতেন, "হেমাঙ্গিনী, হিম, হিমি”— বালিকা যেন আমার প্রতি একটা কর্ণার আবেগে আমাকে জড়াইয়া থাকিত ; একটা আশঙ্কা এবং বিষাদে তাহাকে আচ্ছন্ন করিত। ইহার পর হইতে আমার স্বামীর কথা সে আমার কাছে ভ্ৰমেও উল্লেখ করিত না । ইতিমধ্যে আমার দাদা আমাকে দেখিতে আসিলেন। আমি জানিতাম, দাদার দটি তীক্ষ। ব্যাপারটা কিরুপ চলিতেছে তাহা তাঁহার নিকট গোপন করা প্রায় অসাধ্য হইবে। আমার দাদা বড়ো কঠিন বিচারক। তিনি লেশমাত্র অন্যায়কে ক্ষমা করিতে জানেন না। আমার স্বামী যে তাঁহারই চক্ষের সম্মখে অপরাধীরাপে দাঁড়াইবেন, ইহাই আমি সবচেয়ে ভয় করিতাম। আমি অতিরিক্ত প্রফুল্লতা বারা সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়া রাখিলাম। আমি বেশি কথা বলিয়া, বেশি ব্যস্তসমস্ত হইয়া, অত্যন্ত ধুমধাম করিয়া, চারি দিকে যেন একটা ধলা উড়াইয়া রাখিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু, সেটা আমার পক্ষে এমন অস্বাভাবিক যে তাহাতেই আরও বেশি ধরা পড়িবার কারণ হইল । কিন্তু, দাদা বেশিদিন থাকিতে পারিলেন না, আমার স্বামী এমনি অস্থিরতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন যে, তাহা প্রকাশ্য রাঢ়তার আকার ধারণ করিল। দাদা চলিয়া গেলেন। বিদায় লইবার পাবে পরিপণ স্নেহের সহিত আমার মাথার উপর অনেকক্ষণ কম্পিত হস্ত রাখলেন; মনে-মনে একাগ্রচিত্তে কী আশীবাদ করিলেন তাহা বুঝিতে পারিলাম; তাঁহার আশ্র আমার অশ্রুসিক্ত কপোলের উপর আসিয়া পড়িল । মনে আছে, সেদিন চৈত্রমাসের সন্ধ্যাবেলায় হাটের বারে লোকজন বাড়ি ফিরিয়া যাইতেছে। দর হইতে বাল্টি লইয়া একটা ঝড় আসিতেছে, তাহারই মাটি-ভেজা গন্ধ এবং বাতাসের আদ্রভাব আকাশে ব্যাপ্ত হইয়াছে; সঙ্গচুতে সাথিগণ অন্ধকার মাঠের