পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ෆ H গল্পগুচ্ছ কুষ্ঠিত হইতেন না; শনিয়া তারাপ্রসন্ন বলিতেন, "তোমার একটি বই স্বামী নাই, তুলনা কাহার সহিত করবে।” শনিয়া দাক্ষায়ণী ভারি রাগ করিতেন। দাক্ষায়ণীর কেবল একটা এই মনস্তাপ ছিল যে, তাঁহার স্বামীর অসাধারণ ক্ষমতা বাহিরে প্রকাশ হয় না— স্বামীর সে সম্বন্ধে কিছমাত্র চেষ্টা নাই। তারাপ্রসন্ন যাহা লিখিতেন তাহা ছাপাইতেন না। অনুরোধ করিয়া দাক্ষায়ণী মাঝে মাঝে স্বামীর লেখা শুনিতেন, যতই না বঝিতেন ততই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন। তিনি কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কবিকঙ্কণ-চণ্ডী পড়িয়াছেন এবং কথকতাও শনিয়াছেন। সে-সমস্তই জলের মতো বুঝা যায়, এমনকি নিরক্ষর লোকেও অনায়াসে বুঝিতে পারে, কিন্তু তাঁহার স্বামীর মতো এমন সম্পণে দবোধ হইবার আশ্চৰ্য ক্ষমতা তিনি ইতিপবে: কোথাও দেখেন নাই। তিনি মনে মনে কল্পনা করিতেন, এই বই যখন ছাপানো হইবে এবং কেহ এক অক্ষর বঝিতে পারিবে না, তখন দেশসদ্ধ লোক বিসময়ে কিরুপ অভিভূত হইয়া যাইবে । সহস্রবার করিয়া সবামীকে বলিতেন, "এ-সব লেখা ছাপাও ৷” স্বামী বলিতেন, “বই ছাপানো সম্বন্ধে ভগবান মন স্বয়ং বলে গেছেন : প্রবত্তিরেষা ভূতানাং নিবত্তিস্তু মহাফলা।" তারাপ্রসন্নের চারিটি সন্তান, চারই কন্যা। দাক্ষায়ণী মনে করিতেন, সেটা গভর্ণধারিণীরই অক্ষমতা। এইজন্য তিনি আপনাকে প্রতিভাসম্পন্ন স্বামীব অত্যন্ত অযোগ্য সত্রী মনে করিতেন। যে সবামী কথায় কথায় এমন-সকল দরহে গ্রন্থ রচনা করেন তাঁহার স্ত্রীর গভো কন্যা বই আর সন্তান হয় না, সন্ত্রীর পক্ষে এমন অপটতার পরিচয় আর কী দিব । প্রথম কন্যাটি যখন পিতার বক্ষের কাছ পৰ্যন্ত বাড়িয়া উঠিল তখন তারাপ্রসনের নিশিচন্তভাব ঘনচিয়া গেল। তখন তাঁহার স্মরণ হইল, একে একে চারিটি কন্যারই বিবাহ দিতে হইবে এবং সেজন্য বিস্তর অর্থের প্রয়োজন। গহিণী অত্যন্ত নিশিচন্তমুখে বলিলেন, “তুমি যদি একবার একটুখানি মন দাও তাহা হইলে ভাবনা কিছুই नार्दै ।” তারাপ্রসন্ন কিঞ্চিৎ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “সত্য নাকি । আচ্ছা, বলো দেখি কণী করিতে হইবে।” দাক্ষায়ণী সংশয়শন্য নিরন্দবিগুনভাবে বলিলেন, “কলিকাতায় চলো, তোমার বইগুলো ছাপাও, পাঁচজন লোকে তোমাকে জানকে-– তার পরে দেখো দেখি, টাকা আপনি আসে কি না।” সল্লীর আশ্বাসে তারাপ্রসন্নও কমে আশ্বাস লাভ করিতে লাগিলেন এবং মনে প্রত্যয় হইল, তিনি ইস্তক-নাগাদ বসিয়া বসিয়া যত লিখিয়াছেন তাহাতে পাড়াসন্ধ লোকের কন্যাদায় মোচন হইয়া যায়। এখন, কলিকাতায় যাইবার সময় ভারি গোল পড়িয়া গেল। দাক্ষায়ণী তাঁহার নিরপোয় নিঃসহায় সযত্নপালিত স্বামীটিকে কিছুতেই একলা ছাড়িয়া দিতে পারেন না। তাঁহাকে খাওয়াইয়া পরাইয়া নিত্যনৈমিত্তিক কতব্য সমরণ করাইয়া সংসারের বিবিধ উপদ্রব হইতে কে রক্ষা করিবে ।